করোনাভাইরাস মোকাবিলার সুযোগ এনে দিয়েছে ‘রমজানের চেতনা’

মহামারি করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন ঘোষণা এবং জনসমাবেশ ও জামাতে নামাজে আদায়ে নিষেধাজ্ঞার মতো ভিন্ন বাস্তবতার মাঝে এসেছে এবারের মাহে রমজান। কিন্তু এ মাসের চেতনাই আবার মুসলমানদের মহামারি মোকাবিলার সুযোগ এনে দিয়েছে।

শনিবার থেকে পবিত্র এ মাস শুরু হয়েছে। এ সময়ে মুসলমানরা সূর্যোদয়ের আগে থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানহার থেকে বিরত থেকে রোজা পালন করে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মসংযমের এ মাসের সত্যিকারের চেতনাকে লালন করে শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপন করা মহামারি কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়া রোধেরও সুযোগ নিয়ে এসেছে।

সরকারকে কঠোরভাবে শাটডাউন ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার নিয়মগুলো বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়ে তারা বলেন, এ মাসে যেকোনো ধরনের ইফতার পার্টি বা ধর্মীয় সমাবেশ নিষিদ্ধ এবং মাসটির আসল মর্ম উপলব্ধি না করে বিনা কারণে বিভিন্ন বাজার ও শপিংমলে জড়ো হওয়া থেকে মানুষকে বিরত রাখতে হবে।

ইসলামী চিন্তাবিদরা ঘরে বসে মুসলমানদের বিভিন্ন ধর্মীয় কর্ম, যেমন ফরজ ও নফল নামাজ পড়া, পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করা এবং খাদ্য সংকটে থাকা মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কেননা সর্বশক্তিমান আল্লাহ রমজান মাসে যেকোনো সদকা ও ইবাদতের সোয়াব কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেন।

তারা বলেন, রমজান মাসে অনেক লোক যাকাত দেয়। এসব যাকাত দেয়ার সময় কোনো ধরনের জাহির ও গণসমাবেশ না করে নীরবে অভাবী ও দুস্থ মানুষকে দান করা উচিত।

ইউএনবির সাথে আলাপকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ড. খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ভিন্ন এক বাস্তবতায় এবারের রমজান মাস এসেছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে ঘরে বসে জুমা এবং পাঁচ ওয়াক্তের ফরজ নামাজ মসজিদের পরিবর্তে বাড়িতে আদায় করছি। তারাবির নামাজও আমাদের বাড়িতেই পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘ইসলাম ধর্মের মতে, রমজান আত্মসংযম এবং আত্মশুদ্ধি অনুশীলনের মাস। আমরা বাড়ির বাইরে না গিয়ে ঘরে বসে বেশি বেশি ইবাদত করার সুযোগ পাব এবং এর মাধ্যমে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়াও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।’

অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘যারা রমজান মাসে ঘন ঘন থুতু গিলে ফেলেন তাদের খুব সাবধান থাকা উচিত। কারণ এর ফলে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। সবারই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং ইফতারের সময় একসাথে জড়ো হওয়া এড়িয়ে চলা উচিত।’

ঢামেকের অধ্যক্ষ জানান, রমজানে মাসে ইফতার সামগ্রী এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার জন্য কাঁচাবাজারগুলোতে প্রচুর মানুষের ভিড়ে হয়ে থাকে। সুতরাং, সরকারকে কড়াকড়িভাবে বাজার মনিটরিং করা উচিত, যাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকে। সবচেয়ে ভালো বিকল্প হয় যদি আবাসিক এলাকার প্রতিটি ব্লকে ছোট ছোট পর্যাপ্ত অস্থায়ী দোকান তৈরি করা যায়। তাহলে লোকেরা সহজে প্রয়োজনীয় পণ্য এবং ইফতার সামগ্রী কিনতে পারবে।

তিনি বলেন, ‘সরকার সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে স্কুল-কলেজগুলোতে দুস্থদের মধ্যে মাসব্যাপী রান্না করা খাবার ও ইফতার সামগ্রী সরবরাহের পদক্ষেপ নিতে পারে। এ ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে মানুষকে ঘরে রাখতে আমাদের সরকার ঘোষিত শাটডাউন কড়াকড়িভাবে বাস্তবায়নে আইন প্রয়োগ করতে হবে।’

ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের (ডিসিএমসিএইচ) মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. হারুন-অর-রশিদ বলেন, কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের ফলে যেহেতু পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে তাই রমজান মাসে মুসল্লিদের মসজিদে যাওয়া এবং বাজারে একসাথে জড়ো হওয়া রোধে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে।

তিনি বলেন, সরকারের উচিত রমজান মাসে ইফতার মাহফিল বা ধর্মীয় সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জরি করা, কাঁচাবাজারগুলোতে মনিটরিং জোরদার করার মাধ্যমে সেখানে লোকেদের সমাগম নিয়ন্ত্রণ করা। কেননা, আত্মসংযমের এ মাসে মানুষের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে খাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। মানুষের শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার এবং পানীয় গ্রহণ করতে হবে।

অধ্যাপক হারুন বলেন, এ মাসে ঈদের কেনাকাটা করার জন্য শপিংমলগুলোতেও ভিড় করার প্রবণতা মানুষের মধ্যে রয়েছে। তাই, করোনার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত শপিংমলগুলো খুলে দেয়া সরকারের উচিত হবে না।

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের প্রবীণ পেশ ইমাম মাওলানা মুফতী মিজানুর রহমান বলেন, রমজান মাস অনেক কারণেই বরকতময় এবং যেহেতু জাতি একটি মারাত্মক ভাইরাস সংক্রমণের কবলে রয়েছে তাই মুসলমানদের উচিত এ মাসের সব নেয়ামতের সুযোগ গ্রহণ করা।

তিনি বলেন, হাদিসের বর্ণনা অনুসারে সর্বশক্তিমান আল্লাহ রমজান মাসকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। এ মাসের প্রথম ১০ দিন রহমতের, পরের ১০ দিন মাগফিরাতের এবং শেষ ১০ দিন নাজাতের বা জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের।

এ ইসলামি পন্ডিত বলেন, ‘আমরা যারা বর্তমানের বিপদ থেকে আল্লাহর রহমত, ক্ষমা ও পরিত্রাণ আশা করি, তাদের উচিত হবে অন্য মাসের তুলনায় এ মাসে নিজ বাড়িতে আরও বেশি ইবাদাত করা।’

‘একই সাথে, করোনাভাইরাসে কারণে চলমান শাটডাউনের ফলে অনেক লোক উপার্জন না করতে পারায় কঠিন সময় পার করছেন। আমাদের উচিত এ মাসে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশায় সবারই সামর্থ্য অনুসারে খাদ্য ও আর্থিক সহায়তায় দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো। আল্লার তার ক্ষমতায় এ মাসে দানের মহিমা বহুগুণ বাড়িয়ে দেন। যদি কেউ রোজাদারকে এক চুমুক দুধ দেয় আল্লাহ তাদেরও এর পুরস্কার দেন,’ বলেন তিনি।

মুফতী মিজানুর রহমান বলেন, ‘এ মাসে কোনো ধরনের জাঁকজমকপূর্ণ ইফতার পার্টির ব্যবস্থা না করে নীরবে মানুষকে খাবার, ইফতার সামগ্রী এবং অর্থ দান করা উচিত।’

এ আলেম বলেন, রমজান মাসে যাকাত হিসাবে শাড়ি ও লুঙ্গি দেয়ার জন্য অনেকে জনসমাগম করে থাকেন। এটি ইসলামের নীতির পরিপন্থী। কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া এবং জনসমাবেশ এড়িয়ে চুপিসারে দান করতে হবে। ধনী ব্যক্তিরা তাদের যাকাতের অর্থ আরও ভালোভাবে বিতরণের জন্য আলেম-ওলামার পরামর্শ নিতে পারেন।’

তারাবির নামাজ আদায় সম্পর্কে তিনি বলেন, তারাবির নামাজ জামাত বা মসজিদে আদায় করা বাধ্যতামূলক নয়। নিজের সুরক্ষার জন্য মানুষ মসজিদে না গিয়ে ঘরে বসে তা আদায় করতে পারেন।

ইউএনবির সাথে আলাপকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শফিক আহমদ বলেন, ‘রোজা মানে শুধু খাদ্য-পানীয় এবং মৌলিক প্রবৃত্তি থেকে বিরত থাকা নয়। সেই সাথে খারাপ চিন্তা ও কর্ম থেকে নিজেকে বিরত রেখে আত্মসংযমের মাধ্যমে ব্যক্তি এবং সমাজের জন্য মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসা। গরিব ও সুবিধাবঞ্চিতদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়াও রোজার লক্ষ্য। ভালো মানুষ হয়ে উঠার জন্য এ মাসে আমাদের চেষ্টা করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘রমজান মাস মানুষকে ক্ষুধার যন্ত্রণা উপলব্ধি করার সুযোগ করে দেয়। আমরা যদি আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, সৌজন্যতা এবং দান করার মাধ্যমে এ মাসের চেতনাকে ধারণ করতে পারি তবে আমি বিশ্বাস করি, আমরা ভাইরাস থেকে রক্ষা এবং গরিবদের দুর্দশাগুলো অনুভব করতে পারব। আমাদের শৃঙ্খলা বজায় রাখার অনুশীলন করা এবং এ কঠিন সময় কাটিয়ে উঠতে একে অপরকে সহায়তা করা উচিত।’