ফেইক নিউজ প্রচার বন্ধে মূলধারার গণমাধ্যমকে ভূমিকা রাখতে হবে: আইনমন্ত্রী

ফেইক নিউজ বা ভুয়া খবর বাংলাদেশে নতুন কোনো ধারণা নয় উল্লেখ করে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ফেইক নিউজ সমাজে সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে পারে।

‘ফেইক নিউজ প্রচার ও প্রকাশ বন্ধের জন্য সরকারের একার পক্ষে সফলভাবে কাজ করা সম্ভব নয়, এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলোরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ, ফেইক নিউজের (ভুয়া খবর) প্রভাবে সমাজে সাম্প্রদায়িক, জাতিগত, ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে’, বলেন তিনি।

শনিবার সকালে রাজধানীর কসমস সেন্টারে অনুষ্ঠিত ‘ভুয়া খবর ও ঘৃণামূলক বক্তব্য, কারণ ও পরিণাম: কীভাবে তা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে’ শীর্ষক এক সংলাপ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

বাংলাদেশি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কসমস গ্রুপের জনকল্যাণমূলক সংস্থা কসমস ফাউন্ডেশন এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে আনিসুল হক বলেন, ফেইক নিউজ বা ভুয়া খবর বাংলাদেশে নতুন কোনো শব্দ বা ধারণা নয়। ‘খবর’ ও ‘ভুয়া খবর’ অনেকটা ‘সত্য’ ও ‘মিথ্যা’র মতোই সমান্তরালভাবে যুগযুগ ধরে প্রচার ও প্রকাশ হয়ে আসছে।

তিনি বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীনতা বিরোধীগোষ্ঠী অনেক ফেইক নিউজ ছড়িয়েছিল। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যে দেশে ও বিদেশে অনেক ফেইক নিউজ (ভুয়া খবর) ছড়িয়েছে।

মন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশে প্রধানত পাঁচটি উদ্দেশ্যে ফেইক নিউজ চর্চা করা হয়। এগুলো হচ্ছে- সাম্প্রদায়িক গুজব ছড়ানো, উগ্র রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মিথ্যাচার প্রচার, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, জনমতে আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং অবৈজ্ঞানিক জল্পনা-কল্পনা প্রচার করার জন্য।

ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব প্রভৃতি সাংবাদিকতা-বহির্ভুত যোগাযোগমাধ্যম ভুয়া খবর প্রচারের বড় প্লাটফর্ম উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিপদের দিক হলো- এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য অতি দ্রুতগতিতে সংবাদমাধ্যমগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলো, যাদের অধিকাংশই তথ্যের সত্য-মিথ্যা খতিয়ে দেখে না। তাদের দ্বারা যেকোনো চাঞ্চল্যকর ভুয়া খবর মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো সংবাদ মাধ্যমে।

আনিসুল হক বলেন, বাংলাদেশসহ অনেক দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যম এখন সংবাদের প্রাথমিক উৎস হিসেবে ফেসবুক-টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে থাকে। তবে, কাজটা দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারি দক্ষতার সঙ্গে করলে ঝুঁকির আশঙ্কা কম থাকে।

তিনি উল্লেখ করেন, ফেইক নিউজের প্রচার ও প্রকাশ বন্ধে সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন প্রণয়ন, সাইবার আদালত গঠন এবং গুজব প্রতিরোধ ও অবহিতকরণ সেল গঠনের পাশাপাশি অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য রেজিস্ট্রেশনের উদ্যোগ গ্রহণ এবং অনলাইন নীলিমালা প্রণয়নের কাজ করছে। এছাড়া ফেইক নিউজের প্রচার ও প্রকাশ বন্ধে বিটিআরসি, আইসিটি বিভাগ, পুলিশ বিভাগ ও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও কাজ করছে।

মন্ত্রী বলেন, তবে সরকারের একার পক্ষে এ কাজ সফলভাবে করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

‘মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলোকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ তৈরি এবং দ্রুততম সময়ে সেগুলো পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, যাতে তারা সোশ্যাল মিডিয়ার দারস্থ না হয়’, উল্লেখ করেন তিনি।

সংবাদ মাধ্যমগুলোকে সত্য এড়ানোর প্রবণতা বা নীরবতা থেকে বেড়িয়ে আসার তাগিদ দিয়ে আইনমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষের সত্য জানার পথ যেখানে বন্ধ হয়ে যায়, ফেইক নিউজের পথ চলা সেখান থেকেই শুরু হয়। যে সংবাদ মাধ্যমের বা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট হুবহু নকল হবে, অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তাদেরকেই নিতে হবে। সাইট নকলের ক্ষেত্রে যেকোনো প্রতিষ্ঠিত হাউজের আইনি ব্যবস্থাও গ্রহণ করা উচিত।’

‘ফেইক নিউজ চিহ্নিতকরণের জন্য ইতিমধ্যে ভারতে অল্টনিউজ নামে একটি সফটওয়্যার উদ্ভাবন করা হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে’ এমন তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, ফেইক নিউজ চিহ্নিতকরণের জন্য নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা উচিত। কারণ প্রযুক্তিকে প্রযুক্তি দিয়েই মোকবিলা করা সমীচীন।

আনিসুল হক বলেন, সোশ্যাল মিডিয়াগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে এবং যারা উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে ফেইক নিউজ তৈরি করে, তাদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে। সেই সঙ্গে তাদের অর্থের উৎস খুঁজে বের করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী হিসেবে আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। কোনটা নিউজ আর কোনটা ফেইক নিউজ সে সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা রাখতে হবে। ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় যেকোনো লিংক বা সংবাদ শেয়ার করছি তা শেয়ারের আগে অন্তত কয়েকবার চিন্তা করে দেখতে হবে। কারণ অসচেতনভাবে হলেও একটি ফেইক নিউজ শেয়ার করার কারণে যেকোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে।’

‘আজ আপনি সজ্ঞানে ফেইক নিউজ শেয়ার করলে, আগামীকাল যে নিজেই এর শিকার হবেন না, তা বলা যায় না। এজন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু দেখেই গুজব ছড়ানো যাবে না,’ যোগ করেন তিনি। ধৈর্য ধরে তথ্যটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করারও আহ্বান জানান মন্ত্রী।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতউল্লাহ খান।

অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাকাউন্টিবিলিটি অ্যান্ড ইন্টারনেট ডেমোক্রেসির (এএআইডি) সভাপতি, ইউরোপ ও আইটি আইন বিশেষজ্ঞ ড্যান শেফেট অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের (আইএসএএস) প্রিন্সিপাল রিসার্চ ফেলো ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী।