মোংলায় শুরু হয়েছে রিগন মেলা

বাংলাদেশের প্রতি ইতালীয় বংশোদ্ভূত ফাদার মারিনো রিগনের অসামান্য অবদান এবং তার আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড মানুষের কাছে তুলে ধরতে বাগেরহাটের মোংলায় শুরু হয়েছে রিগন মেলা। মোংলার হলদিবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে মঙ্গলবার খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক তিন দিনব্যাপী এই মেলার উদ্বোধন করেন। মেলাকে ঘিরে ফাদার মারিনো রিগন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ ভিড় করছেন মেলায়। রিগন মেলা চলবে আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। ফাদার মারিনো রিগন বাংলাদেশের অকৃতিম বন্ধু। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত এই নাগরিক। রিগনের মৃত্যুতে তার জীবন থেমে গেলেও থেমে যায়নি তার শুরু করে যাওয়া কর্মকাণ্ড। শিক্ষা বিস্তার ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যে রিগনের নিজের হাতে গঠন করে যাওয়া ‘রিগন ফাউন্ডেশন’ সামাজিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ফাদার মারিনো রিগনের সকল সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ড দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যে ২০০৮ সাল থেকে রিগন ফাউন্ডেশন প্রতিবছর এ মেলার আয়োজন করে আসছে।

জানা গেছে, ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসে ২৮ বছর বয়সে ধর্ম প্রচার করতে ইতালি থেকে বাংলাদেশে আসেন ফাদার মারিনো রিগন। এরপর বাগেরহাটের মোংলার শেহলাবুনিয়া গ্রামে থেকে তিনি এই এলাকার শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ নেন। একে একে গড়ে তোলেন ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের জন্য গড়ে তোলেন থাকার হোস্টেল। নারীর আত্মকর্মসংস্থানের জন্য গড়ে তোলেন সেলাই কেন্দ্র। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিতে ফরিদপুরের বানিয়ারচরে নিজের প্রতিষ্ঠিত চার্চে তিনি গোপনে চিকিৎসা ক্যাম্প স্থাপন করে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা ও সহায়তা প্রদান করতেন। মুক্তিযুদ্ধে তার এ অসামান্য অবদান ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য ২০০৯ সালে ৩০ ডিসেম্বর তাকে দেয়া হয় বাংলাদেশের সম্মান সূচক নাগরিকত্ব।

ফাদার মারিনো রিগন বাংলাকে ভালোবেসে রপ্ত করেছিলেন বাংলা ভাষা, ভাষার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গীতাঞ্জলি, কবি জসিমউদ্দিনের নকশী কাঁথার মাঠ, সুজন বাদিয়ার ঘাট সহ ৪৮টি কাব্যগ্রন্থ, বাউল সম্রাট লালন শাহের সাড়ে তিনশ গান ইতালি ভাষায় অনুবাদ ও সংকলন করে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি কবি জসিম উদ্দিন একাডেমি পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা পেয়েছেন। ১৯৭৩ সালে কবি জসিম উদ্দিনকে সাথে নিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেন। রিগন ফাউন্ডেশনের সভাপতি সুভাষ বিশ্বাস জানান, ফাদার মারিনো রিগন কে এবং তার কি উদ্দেশ্য ছিল তা জানাতে আমরা প্রতিবছর রিগন মেলার আয়োজন করি। রিগনের লেখা বই, অনুবাদ করা বই এবং যেসব পদক পেয়েছেন সেসব এই মেলায় প্রদর্শন করা হচ্ছে। মানুষ রিগনের এই সব দেখলে উৎসাহিত হয়। মেলার আকর্ষণ বাড়াতে আয়োজন করা হয়েছে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতা, যাত্রাপালা, লোক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

মোংলা সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনিন্দ্র হালদার জানান, ফাদার মারিনো রিগম নারীদের শিক্ষা এবং নারীদের স্বাবলম্বী করতে নানা ধরনের উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড করে গেছেন। রিগন ফাউন্ডেশন থেকে সুবিধা নিয়ে লেখাপড়া করা চয়ন মজুমদার এবং হাসি সরদার জানান, ফাদার মারিনো রিগন তাদের জীবনের চাকা ঘুরিযে দিয়েছেন। তার সাহায্য, সহযোগিতা আর অবদানের কারণে আজ তারা লেখাপাড়া করে বড় হয়েছে। ২০১৪ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য ইতালি গমন করেন এবং ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর তিনি সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে স্বজনদের কাছে তার শেষ মিনতি ছিল, মৃত্যুর পর তার তার মৃতদেহটি যেন বাংলাদেশে সমাহিত করা হয়। তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর বাংলাদেশে ফেরত আনা হয় তার মৃতদেহ। বাগেরহাটের মোংলায় তার প্রতিষ্ঠিত শেহালাবুনিয়া চার্চে রিগনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। সূত্র-ইউএনবি

আজকের বাজার/আখনূর রহমান