জ্বালানিতে শস্যের ব্যবহার,খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মূখে

গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স অনুযায়ী অন্যতম ক্ষুধার্ত দেশের তালিকায় ২৫-শে থাকা বাংলাদেশ পরিবেশ উপযোগী জ্বালানি নিশ্চিত করার জন্য খাদ্যশস্য ব্যবহার করে ইথানল তৈরির যে পরিকল্পনা করছে, তাতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা বাংলাদেশে এখনো অনেক শস্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।

থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের বরাত দিয়ে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা। অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে রয়টার্স।

এ বছরের শুরুর দিকে সবুজ জ্বালানি উৎপাদন-সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়, ভুট্টা, ভাঙা চাল আর গুড় ব্যবহার করে বাংলাদেশ ইথানল তৈরি করবে যা, পেট্রলের সঙ্গে পাঁচ শতাংশ হারে মেশানো হবে। থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী আর পরিবেশবাদীরা বলছেন, এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনে কার্বন নিঃসরণের হিসাবে বাংলাদেশ খুব কম পরিমাণেই কার্বন নিঃসরণ করে। সেখানে বিদেশ থেকেই বাংলাদেশে ভুট্টা এবং অন্য খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। সেখানে এসব পণ্য ব্যবহার করে ইথানল তৈরি করা হলে খাদ্য সংকট তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে দরিদ্রদের জন্য।

বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটির মুখপাত্র মশিউর রহমান এই সিদ্ধান্তকে ‘আত্মঘাতী’ বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ ভুট্টা পোলট্রিশিল্পে মুরগির খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু অর্ধেকের বেশি ভুট্টা যুক্তরাষ্ট্র আর ব্রাজিল থেকে আমদানি করতে হয়। সেখানে এটি ইথানল তৈরির কাজে ব্যবহার করা শুরু হলে দাম অনেক বেড়ে যাবে, যার প্রভাব পড়বে সব ক্ষেত্রে। তিনি বলছেন, ‘ইথানল তৈরির কাজে ব্যবহার শুরু হলে ভুট্টার দাম অনেক বেড়ে যাবে। সুতরাং দাম বাড়বে ডিম আর মুরগির, যা হয়তো সাধারণ মানুষের আওতার বাইরে চলে যাবে।’

বাংলাদেশের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা অনুযায়ী, দেশে বছরে এক কোটি ৮০ লাখ লিটার ইথানল তৈরি করা সম্ভব। এ জন্য ৬০ হাজার টন ভাঙা চাল দরকার হবে, যা মোট উৎপাদনের প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ। চালের বিকল্প হিসেবে ভুট্টা লাগবে ৬২ হাজার টন, যা মোট উৎপাদনের ২ দশমিক ৮ শতাংশ আর গুড় লাগবে ৯৭ হাজার টন, যা মোট উৎপাদনের সমান।

তবে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদনেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে যে, এই মাত্রার চেয়ে বেশি খাদ্যশস্য জ্বালানি উৎপাদনে ব্যবহার করলে তা খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে বলেছেন, ‘অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশকেও সবুজ ও বিকল্প জ্বালানি উৎপাদনের দিকে যেতে হবে। অন্য জ্বালানির পাশাপাশি জৈব জ্বালানি উৎপাদনের দিকটিও আমরা খতিয়ে দেখতে চাই।’ তিনি বলেন, ‘খুব তাড়াতাড়ি আমরা জৈব জ্বালানি উৎপাদনের অনুমতি দিতে যাচ্ছি। দেখা যাক, আগে কী হয়। এরপর খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার কথা বিবেচনার আগেই সরকার খাদ্য পুড়িয়ে ইথানল তৈরির পরিকল্পনা করছে যে স্বল্প আয়ের দেশটি এর মধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিতে রয়েছে। যেখানে ঝড়, বন্যা, খরা বা লবনাক্ততায় ফসলহানি হয়, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিরও ঝুঁকি রয়েছে।

গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স অনুযায়ী, বিশ্বের অন্যতম ক্ষুধার্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ ২৫তম, যেখানে দেশের অনেক মানুষ দিনে দুইবেলা পেটপুরে খেতে পায় না। পশুখাদ্যের পাশাপাশি অনেক মানুষ নিয়মিত ভুট্টা খেয়ে থাকে। বিশেষ করে আটার সাথে মিশিয়ে বিস্কুট ও বিভিন্ন খাবার তৈরি হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে চলেছে। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে মোটা চালের দাম ২৫ শতাংশ বেড়ে ৪২ টাকায় উঠেছে। খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির বিষয় উদ্বেগের কারণ, দেশের বেশির ভাগ মানুষের আয়ের বড় অংশ খাবারের পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারি মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৬.৮ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১৩ শতাংশ বাংলাদেশী দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে চাহিদার চেয়ে বেশি ধান উৎপাদিত হয়, কিন্তু বাকি খাদ্য শস্যের জন্য বছরে ৪৫ লাখ টন গম আমদানি করতে হয়।

তবে ইথানল উৎপাদনের জন্য প্রথম আবেদনকারী প্রতিষ্ঠান সুনিপুণ অর্গানিক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খান মো. আফতাবউদ্দিন মনে করেন না, এটি খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কোন হুমকি তৈরি করবে। কারণ জৈব জ্বালানি তৈরির উদ্বৃত্ত জিনিস পোলট্রি বা মাছের খাবার হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তিনি থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে বলেছেন, ‘দরকার হলে চর এলাকায় আমরা ভুট্টা চাষ করে আমাদের কাঁচামাল সংগ্রহ করব।’

তবে খাদ্যশস্য থেকে জৈব জ্বালানি উৎপাদনের সিদ্ধান্তকে ভুল সিদ্ধান্ত বলে বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন অধ্যয়ন ইন্সটিটিউটের ফেলো মো. আসাদুজ্জামান। থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে তিনি বলছেন, ‘গবাদিপশুর পুষ্টি নিয়ে এখনো আমাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এখন ভুট্টা যদি ইথানল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, এসব প্রাণী আরো পুষ্টিহীনতায় ভুগবে। এটা একেবারেই একটি ভুল সিদ্ধান্ত।’ তিনি বলেন, ‘যত দিন না আমরা আমাদের মৌলিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে না পারছি, তত দিন আমাদের সবুজ জ্বালানি নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা প্রধান গোলাম মোয়াজ্জেম থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে বলেছেন, ‘ইথানল উৎপাদন একবার শুরু হলে এর চাহিদা বাড়তেই থাকবে, বিশেষ করে তেলের দাম যদি বেড়ে যায়। ফলে আরো খাদ্যশস্যের দরকার হবে। কিন্তু বাংলাদেশে যেহেতু কৃষিজমির সংকট রয়েছে, তখন প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদনও ব্যাহত হবে।’