অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই হবে গ্রেনেড হামলা মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি

এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারিক আদালতের রায় বিষয়ে আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি উচ্চ আদালতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হবে।

আগামী ২১ আগস্ট শুক্রবার ভয়াবহ বর্বরোচিত ওই হামলার ১৬ তম বার্ষিকী। ২০০৪ সালের এই দিনে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগে একটি শান্তি সমাবেশে এই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এ হামলায় অল্পের জন্যে বেঁচে যান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা। তবে, তার কান ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

সেদিনের সেই গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদিক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লর রহমানের সহধর্মিনী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং আহত হন অনেকে। এদের অনেকে এখনও দুঃসহ সেই ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন।

এটর্নি জেনারেল বলেন, মামলাটির গুরুত্ব উল্লেখ করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির আবেদন করা হবে। যেন শুনানির জন্য একটি বেঞ্চে পাঠানো হয়। মাহবুবে আলম বলেন, বিচারিক আদালত আসামিদের যে সাজার রায় প্রদান করেছেন তা যেন বহাল থাকে উচ্চ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের সে প্রচেষ্টা থাকবে।

তিনি বলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট বর্বরোচিত এ হামলার ঘটনা। ইতোমধ্যে অনেক সময় অতিবাহিত হয়েছে। ভয়াবহ ও নৃশংস ওই হামলার যেন বিচার না হয় এবং আসল আসামিরা ধরা না পরে সেজন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে। একটি রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্ন করতে এরূপ নারকীয় হামলার ঘটনা পৃথিবীতে আর হয়নি।

চাঞ্চল্যকর এ মামলায় বিচারিক আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে প্রধান কৌসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান বাসস-এর সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘এ মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে সাক্ষ্য তথ্য প্রমাণে দেখেছি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার জঙ্গি গোষ্ঠীর সহায়তা নিয়ে ইতিহাসের জঘন্যতম এ ঘটনা ঘটিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি সংঘবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করাই ছিল ভয়াবহ ওই গ্রেনেড হামলার লক্ষ্য।’

সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, ‘যুদ্ধে ব্যবহৃত সমরাস্ত্র দিয়ে নিরস্ত্র মানুষ এবং কোন রাজনৈতিক দলের সমাবেশে হামলার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।’

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মামলার পেপারবুক প্রস্তুত হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের মুখপত্র ও বিশেষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বাসস’কে জানান, ২১ আগস্ট গ্রেনেড মামলার পেপার বুক ১৬ আগষ্ট সুপ্রিমকোর্টে পৌঁছেছে।

ইতিহাসের জঘন্যতম ও বর্বরোচিত এ হামলা মামলায় বিচারিক আদালতের দেয়া রায়সহ ৩৭ হাজার ৩৮৫ পৃষ্ঠার নথিপত্র ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে পাঠানো হয়।

দীর্ঘ বিচারিক কার্যক্রম শেষে একই বছরের ১০ অক্টোবর এ মামলায় পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় স্থাপিত ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে রায় দেয়া হয়।

রায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলটির নেতা হারিছ চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। বিএনপি নেতা সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদন্ড দেন আদালত। তবে যাবজ্জীবন দন্ড পাওয়া এই ১৯ আসামির মধ্যে ১৩ জনই পলাতক।

আদালতের রায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরা হলেন শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফের আবু ওমর আবু হোমাইরা ওরফে পীরসাহেব, মাওলানা সাব্বির আহমদ ওরফে আবদুল হান্নান সাব্বির, আরিফ হাসান ওরফে সুজন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, আবু বকর ওরফে সেলিম হাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফ, মহিবুল মোত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন (পলাতক), আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন (পলাতক), মো. খলিল (পলাতক), জাহাঙ্গীর আলম বদর ওরফে ওস্তাদ জাহাঙ্গীর (পলাতক), মো. ইকবাল (পলাতক), লিটন ওরফে মাওলানা লিটন (পলাতক), তারেক রহমান ওরফে তারেক জিয়া (পলাতক), হারিছ চৌধুরী (পলাতক), কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ (পলাতক), মুফতি শফিকুর রহমান (পলাতক), মুফতি আবদুল হাই (পলাতক) এবং রাতুল আহম্মেদ বাবু ওরফে বাবু ওরফে রাতুল বাবু (পলাতক)।

মৃত্যুদন্ড পাওয়া কারাগারে থাকা ১৭ আসামি হলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআই মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুর রহিম, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মো. আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে মো. ইউসুফ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জিএম, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন ওরফে খাজা ওরফে আবু জানদাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ, মো. রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে শামিম ওরফে রাশেদ ও মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন। মৃত্যুদন্ড পাওয়া পলাতক দুই আসামি হলেন আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই ও জঙ্গিনেতা মাওলানা মো. তাজউদ্দীন এবং হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ।

মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ৫১১ সাক্ষীর মধ্যে ২২৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। আসামিপক্ষে ২০ জনের সাফাই সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট বিকালে দলটির উদ্যোগে সমাবেশ চলছিলো। সমাবেশের প্রায় শেষ পর্যায়ে বক্তৃতা করছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনা। একটি ট্রাকের ওপর তৈরি অস্থায়ী মঞ্চে তিনি বক্তৃতা দেয়ার সময় তার পাশে ছিলেন দলীয় নেতারা। সামনে ছিলেন হাজার হাজার নেতাকর্মী।

বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে প্রচন্ড শব্দে গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয়। এ হামলায় অল্পের জন্যে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। তবে তার কান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেদিনের সেই গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং আহত হন কয়েকশ নেতাকর্মী। এর মধ্যে এখনও অনেকে দুঃসহ সেই ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন।

হামলার ঘটনায় পৃথক তিন মামলা: ভয়াবহ এ গ্রেনেড হামলার পরদিন অর্থাৎ ২২ আগস্ট মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এ মামলাটির প্রথমে তদন্ত শুরু করে থানা পুলিশ। পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ হয়ে তদন্তের দায়িত্ব গড়ায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে। অবশ্য এর মধ্যে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আবদুল জলিল ও আওয়ামী লীগ সাবের হোসেন চৌধুরী আরও দু’টি মামলা করেছিলেন। পরে এসব মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।

আলোচিত জজ মিয়া ‘নাটক’: ভয়াবহ এ হামলা মামলার তদন্তের এক পর্যায়ে ২০০৫ সালের ৯ জুন জজ মিয়াকে আটক করা হয়। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলার সেনবাগের একটি চায়ের দোকান থেকে তাকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে নেয়া হয় সেনবাগ থানাড। পরবর্তীতে সিআইডি পুলিশের হেফাজতে থাকার পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের গ্রেনেড হামলা মামলাড তিনি ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দিয়েছেন বলে জানায় পুলিশ। পরে ফাঁস হয়ে যায় ‘জজ মিয়ার বিষয়টি পুলিশের সাজানো নাটক।’

এ নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনা সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে নানা ঘটনাপ্রবাহের পর ২০০৮ সালে জজ মিয়াকে আসামির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। পরে আদালত এ মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেন। ২০০৯ সালে মুক্তি পান জজ মিয়া।

২০০৮ সালের জুনে প্রথম অভিযোগপত্র : দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির। ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। এরপর মামলার তদন্তের দায়িত্ব¡ পান সিআইডির পুলিশ সুপার আবদুল কাহ্হার আখন্দ। সম্পূরক চার্জশিট: গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়েরর করা মামলায় ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক চার্জশিট (অভিযোগপত্র) জমা দেয় সিআইডি। এতে নতুন করে ৩০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।

তারেক রহমানসহ ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৫২ জনের বিরুদ্ধ হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি অভিযোগপত্র দেয়া হয়। পরে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং অন্য মামলায় জঙ্গি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান ও জেএমবি সদস্য শহিদুল আলম বিপুলের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ায় এ মামলা থেকে তাদের নাম বাদ দেয়া হয়। এখন এ মামলার আসামি সংখ্যা ৪৯। এর মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জন পলাতক রয়েছেন। সাত বছরে ৬ তদন্ত কর্মকর্তা: গ্রেনেড হামলার পর পুলিশের একটিসহ মোট তিনটি মামলা করা হয়।

তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তদন্ত শুরু হয়, যদিও কোনো প্রতিবেদন তখন দাখিল হয়নি। প্রথম সাত বছরের মোট ছয়বার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে নতুন তদন্তে সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর ২০০৮ সালের ১১ জুন অভিযোগপত্র জমা দেন। পরবর্তীতে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। সম্পূরক অভিযোগ পত্র আমলে নিয়ে পরবর্তী সকল বিচারিক ধাপ অতিক্রম শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর রায় দেন বিচারিক আদালত। এখন ওই রায়ের বিষয়ে আনা আসামিপক্ষে আপিল এবং ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য মামলা হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান