আওয়ামী লীগের ৭০ বছরে পদার্পণ

ঐতিহাসিক ২৩শে জুন আজ। ১৯৪৯ সালের এই দিনে প্রতিষ্ঠা পাওয়া দেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।

বৃটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২২ মাসের মাথায় পুরোনো ঢাকার রোজ গার্ডেনে আত্মপ্রকাশ করে নতুন দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ দল। পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে ২৩ ও ২৪ জুন অনুষ্ঠিত দুদিনব্যাপী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গঠিত কমিটিতে সভাপতি হয়েছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন শামসুল হক এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সে সময় শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে বন্দি। বয়স ছিল মাত্র ২৯।

স্বাধীনতার এত অল্প সময়ের মধ্যে কেন মুসলীম লীগের বিপরীতে আরেকটি দল করার দরকার পড়েছিল? জন্মের পর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক নীতির বিরুদ্ধে একটি প্রগতিশীল উদার জাতীয়তাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে সর্বস্তরের জনগণের কাতারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের নামকরণ করা হয় ‘পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগ’, যা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে পরিণত হয়। মওলানা ভাসানীর মতো বর্ষীয়ান নেতার হাতে দলটি প্রতিষ্ঠিত হলেও বেশিদিন সঙ্গে থাকেননি তিনি। রাজনৈতিক মত ভিন্নতার কারণে ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। তার আগেই ১৯৫২ সালে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ওই বছরই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি। এর পর ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত টানা ১৩ বছর দলটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল মিলে গঠিত হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট। যারা ১৯৫৪-এর জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়। ’৫৪-এর নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ বৃহত্তর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট পেয়েছিল ২২৩টি আসন যার মধ্যে ‘পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এককভাবে পেয়েছিল ১৪৩টি আসন। ২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দুই বছর আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ছয় দফা কর্মসূচি আওয়ামী লীগকে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এই ছয় দফার ভিত্তিতেই ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে। ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন দখল করে আওয়ামী লীগ ৩১৩ আসন-বিশিষ্ট পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং সরকার গঠনে ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নের যোগ্যতা অর্জন করে। প্রাদেশিক পরিষদের আসনের মধ্যে ২৮৮ আসন পায় দলটি। জাতীয় পরিষদের সাতটি মহিলা আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের দশটি মহিলা আসনের সবগুলোতেই জয়ী হয় আওয়ামী লীগ।

সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানানোর পরিবর্তে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে বাঙালির অধিকার নস্যাৎ করার পথ বেছে নেয়।

৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেও পূর্বঘোষিত ৩ মার্চের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করল ইয়াহিয়া খান তখন রাজপথে লাখো লোক নেমে এলো। শুরু হলো আরেক দফা আন্দোলন। তারপর জাতির জনক ৭ই মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে তিনি সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসনামলে নির্যাতন আর নিপীড়নের মধ্যে পড়ে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি। দলের মধ্যেও দেখা দেয় অনৈক্য-বিভেদ।

১৯৮১ সালের ১৩ থেকে ১৫ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে জাতীয় ও দলীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনাকে তার অনুপস্থিতিতেই আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। ওই বছরের ১৭ মে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসেন। দলীয় সভাপতি হিসেবে দেশে ফিরে কয়েক ভাগে বিভক্ত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করেন শেখ হাসিনা। এরপর আন্দোলন শুরু করেন সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে।

২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। পাঁচ বছর শাসনের পর ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। এরপর দেশে নতুন রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে জয়ী হয়ে সরকারে ফেরে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়।

আওয়ামী লীগের ইতিহাস মানেই বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস। যে দলটির হাত ধরে এসেছে সবথেকে গর্বের অর্জন স্বাধীনতা, সে দলটি তার অতীত ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে বলেই প্রত্যাশা সাধারণ মানুষের।

আরজেড/