এলপি গ্যাস: ঘাটতি অর্ধেকেরও বেশি, দামে নৈরাজ্য

বাসাবাড়িতে নতুন গ্যাস-সংযোগ বন্ধ। এ খাতে পাইপলাইনে গ্যাস সংযোগ বা সরবরাহ নিরুৎসাহিত করছে সরকার। ভবিষ্যৎ জ¦ালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিকল্প হিসেবে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম (এলপি) গ্যাস ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এলপি গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানোর সরকারি পরিকল্পনা তেমন একটা বাস্তবায়ন হয়নি।

দাম কমিয়ে আবাসিক খাতে এলপি গ্যাসের ব্যবহার বাড়াতে ৫ বছর আগে সরকার দুটি এলপিজি প্লান্ট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল। এর একটিও আলোর মুখ দেখেনি। অন্যদিকে এলপি গ্যাসে সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে তাও যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের পকেটে।

এলপি গ্যাসের ব্যবহার বাড়াতে প্রয়োজনে এতে ভর্তুকি দেওয়া হবে বলেও বিভিন্ন অনুষ্টানে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী বিদ্যুৎ,জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করার পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণ করান কথাও বলেছেন তিনি। কিন্তু এখনও তা কার্যকর হয়নি।

ঢাকা ও এর আশেপাশে অসংখ্য নতুন বাড়ি ও ফ্ল্যাটে এলপি গ্যাসের ব্যবহার শুরু হয়েছে। এ ছাড়া নগরের যেসব এলাকায় পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ থাকে না, সেখানকার মানুষ পাইপলাইনে গ্যাসের বিলও দিচ্ছেন আবার চড়াদামে এলপিজি ব্যবহারও করেছেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়ে কম পরিমাণ গ্যাস প্রায় দ্বিগুণ দামে কিনতে হয় বাংলাদেশের মানুষকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০২০ সাল নাগাদ প্রতি বছর এলপি গ্যাসের প্রয়োজন হবে ১০ লাখ মেট্রিক টনের। বর্তমান চাহিদা প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু সরবরাহ করা হচ্ছে ২ লাখ টনের মতো। এরমধ্যে মাত্র ১৬ থেকে ১৮ হাজার মেট্রিক টন এলপিজি তৈরি করা হয় সরকারিভাবে। আর বেসরকারি কোম্পানিগুলো পৌনে ২ লাখ টনের মতো এলপিজি আমদানি করে। বিশাল এই ঘাটতিকে পুঁজি করে কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে অনৈতিকভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের মতো ভারতেও এই গ্যাসের বেশিরভাগ আমদানি করা হয়। সেখানে প্রতি সিলিন্ডারে এলপি গ্যাস থাকে ১৪ দশমিক ২ কেজি। সেখানে এক সিলিন্ডার এলপি গ্যাসের সর্বোচ্চ খুচরামূল্য ৭৫০ টাকার মতো। অথচ বাংলাদেশে ১২ কেজির এক সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে হয় নির্ধারিত দামের চেয়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি দিয়ে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতে এলপি গ্যাস ব্যবহারকারীদের নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাব রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুযায়ী তারা নির্ধারিত দামে গ্যাস কেনেন। বছর শেষে যে পরিমাণ সিলিন্ডার কেনেন সে হিসেবে তার অ্যাকাউন্টে ভর্তুকির টাকা জমা হয়ে যায়। এতে ১৪ দশমিক ২ কেজি ওজনের প্রতি সিলিন্ডারের দাম পড়ে ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকার মতো।

খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী খুচরা পর্যায়ে ১২ কেজি এলপিজির দাম সর্বোচ্চ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।
বিপিসি সূত্র জানায়, সরকারিভাবে সাড়ে ১২ কেজি ওজনের প্রতি বোতল এলপিজি তৈরি করতে খরচ হয় প্রায় ১১শ টাকা। সরকার ভর্তুকি দিয়ে কারখানার গেটে তা বিক্রি করছে ৬৪০ টাকায়। খুচরা পর্যায়ে এর দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে ৭শ’ টাকা। কিন্তু বাজারে এ দামে গ্যাস পাওয়া যায় না।

সরকারিভাবে উৎপাদন করা এলপি গ্যাস সিলিন্ডার বিপণনের জন্য সারাদেশে যেসব ডিলার রয়েছে তারা একই সাথে বেসরকারি এলপি গ্যাসও বিক্রি করে। এতে করে তারা সরকারি গ্যাসও বেসরকারি দামে বিক্রি করছে। বর্তমানে বেসরকারিভাবে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম সাড়ে ১২শ’ থেকে দেড় হাজার টাকা।

বিপিসির একজন পরিচালক মীর আলী রেজা আজকের বাজারকে বলেন, বাড়তি দামে গ্যাস বিক্রির খবর আমরাও পাই। কিন্তু আমাদের জনবল খুবই সীমিত। আমাদের মাত্র একটা অফিস রয়েছে চট্টগ্রামে। এই সীমাবদ্ধতার কারণে সারাদেশে মনিটরিং করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসনকে এ বিষয়ে বারবার বলা হলেও ঠিকমতো তদারকি হচ্ছে না।
এদিকে সিলিন্ডারের মান ও গ্যাসের মাপ নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কোনো কোনো কোম্পানির সিলিন্ডারে সঠিক মাপে গ্যাস পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া কোনো কোনো কোম্পানির সিলিন্ডার দিয়ে গ্যাস লিক করে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। কখনও কখনও তা বিপদও ডেকে আনে।

সরকারি এলপিজি প্লান্ট: ২০১২ সালে ১০০ মেট্রিক টন করে দুটি এলপি গ্যাস সিলিন্ডারজাত কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় সরকার। এর একটি মংলায়, অন্যটি চট্টগ্রামের কুমিরায়। কিন্তু এর তেমন কোন অগ্রগতিই নেই, জানতে চাইলে মীর আলী রেজা আজকের বাজারকে বলেন, এলপিজি প্লান্ট করার জন্য ভারতের টাটা কোম্পানিকে প্রথমে কাজ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা তা না করেই চলে যায়। এখন ১১ টা কোম্পানির কাছ থেকে প্রস্তাব এসেছে। এগুলো যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।

বিপিসির একটি সূত্র জানায়, ওই দুটি স্থান বাদ দিয়ে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার লতিফপুরে দুটি এলপিজি প্লান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মীর আলী রেজা বলেন, জমি অধিগ্রহন নিয়ে একটা জটিলতা চলছে। তাই এখনই নির্দিষ্ট বলা যাচ্ছে না, প্লান্ট দুটো ঠিক কোথায় হবে। বাসা-বাড়িতে এলপি গ্যাস জনপ্রিয় করতে এর নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে মঙ্গলবার থেকে ঢাকায় দু’দিনের এশিয়া এলপিজি সামিটের আয়োজন করা হয়। সেখানে এলপিজির দাম কমানোর পাশাপাশি এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পায়।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, পাইপলাইনের গ্যাসের ওপর সারা দেশের মানুষের অধিকার থাকলেও তা খুব কমসংখ্যক মানুষ ব্যবহার করে। সরকার এলপি গ্যাসে ভর্তুকি দিলে সাধারণ মানুষের জ্বালানি পেতে সহজ হবে। তিনি বলেন, জ্বালানী খাতে দীর্ঘদিন ধরেই নৈরাজ্য চলছে। সরকার কারিগরি দিক বিবেচনায় কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। ফলে অস্বচ্ছতা থেকেই যাচ্ছে। ব্যক্তিস্বার্থে বিভিন্ন চক্র এই গ্যাস খাতকে জিম্মি করেছে। রাষ্ট্র তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছেও বলে তিনি অভিযোগ করেন।

তার মতে, জ্বালানী খাতে সরকারের অনেক প্রতিষ্টান অনেক মুনাফা করছে। সেই মুনাফার একটা অংশ দিয়ে তহবিল গঠন করে এলপিজিতে ভর্তুকি দিয়ে দাম কমানো সম্ভব। সেই সাথে সাধারন মানুষ যাতে ভর্তুকির সুবিধা পান সেটাও তদারকি করতে হবে।

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা ও নতুন কূপ খননে ব্যর্থতা ঢাকতেই এলপিজি ব্যবহার বাড়ানোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে সরকার। আরেকটি উদ্দেশ্য হলো- কিছু ব্যবসায়ীর স্বার্থে সিলিন্ডার ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি করা।

আজকের বাজার:এনএল/ এলকে/১৭ জানুয়ারি ২০১৮