জুমার দিনের তাৎপর্য, আমল ও বিধি-বিধান

আজ পবিত্র জুমা’র দিন শুক্রবার। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের জন্য সপ্তাহের এই দিনটিকে বিশেষভাবে আয়োজন করেছন। এই দিনে ঈমামের সঙ্গে দু্’রাকার নামাজ সপ্তাহের অন্যান্য দিনের নামাজের চেয়ে উত্তম করে দিয়েছেন। আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা জুমার নামাজের ফজিলত কিংবা জুমার আমল ও বিধি-বিধান। চলুন তাহলে এই পবিত্র দিনটি সম্পর্কে হাদিস ও কুরআনের আঙ্গিকে ব্যাখা জেনে নেই।

জুমার দিনের তাৎপর্য, জুমার আমল ও বিধি-বিধান নিম্নে আলোচনা করা হলো-

“হে ইমানদারগণ, জুমুআর নামাযের জন্য আযান দেয়া হলে তোমরা আল্লাহর স্বরণে তাড়াতাড়ি ছুটে যাও এবং ক্রয়-বিক্রয় পরিত্যাগ কর।” (সূরা জুমুআ : ৯)

জুমার দিনটি মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর রয়েছে অনেক ফযীলত ও মর্যাদা, রয়েছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধি-বিধান।

নিন্মে উক্ত বিষয়গুলো অতি সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হল। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীন সম্পর্কে জানা ও মানার তাওফীক দান করুন। আমীন।

*সর্বশ্রেষ্ঠ দিন কোনটি এবং কেন?

হযরত আবুহুরাই (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হল জুমার দিন। এই দিনে আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিনে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান হয়েছে, এই দিনেই তাকে জান্নাত থেকে বাহির করা হয়। আর এই দিন ছাড়া অন্য কোন দিনে ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না।” (মুসলিম)

* জুমার সলাতের গুরুত্ত্ব-

হযরত আবুল জা’দ জমারী (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “অলসতা-অবহেলা করে যে ব্যক্তি তিন জুমাহ পরিহার করবে আল্লাহ তায়ালা তার ক্বলবে মহর মেরে দিবেন।” (আবুদাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজা)

* জুমার দিনে দরূদ পড়ার ফজিলত-

হযরত আউস বিন আউস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের দিন সমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হল জুমার দিন। এই দিনে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিনে তাকে মৃত্যু দেওয়া হয়েছে, এই দিনে সিংগায় ফু দেওয়া হবে এবং মহা বিপর্যয়ও (ক্বিয়ামত) ঘটবে এই দিনেই। তাই এই দিনে তোমরা বেশি বেশি আমার উপর দরুদ পাঠ করবে;কেননা তোমাদের দরুদ আমার উপর বখশান হয় জুমার দিনে।” (আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনু মাজা)

* জুমার সলাতে দ্রুত মসজিদে যাওয়ার ফযিলত-

হযরত আবুহুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “জুমার দিনে মসজিদের দরজায় ফেরেশতাগণ দাড়িয়ে যান; পর্যায়ক্রমে লেখতে থাকেন প্রথমে আগমন কারীদের ফজীলত। সর্বপ্রথম আগমন কারী একটি উট কুরবানী করার মত সুয়াব লাভ কেরন, পরের জন গরু,তারপরের জন দুম্বা,তারপরের জন মুরগী এবং তারপরের জন ডিম কুরবানী দেওয়ার মত সাওয়াব লাভ করেন। অতপর ইমাম যখন বের হন, তখন তারা খাতা-পত্র গুটিয়ে রেখে মনযোগ দিয়ে খুৎবা শুনেন। (বুখারী, মুসলিম)

* দু রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করা-

হযরত জাবের (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুৎবা দিচ্ছিলেন এমন সময় সালীক গাতফানী নামের এক সাহাবী এসে মসজিদে বসে পড়লেন; রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বল্ললেন, হে সালীক দাড়াও, দুরাকাত নামায পড়,তবে সংক্ষেপে পড়। এরপর তিনি (সমেবেত জনতা সম্বধন করে) বললেন, জুমার দিনে ইমামের খুৎবা চলাকালেও যখন তোমাদের কেউ আসবে তখনও যেন সে ২ রাকাত নামায পড়ে নেয় এবং যেন তা সংক্ষেপ করে। (বুখারী, মুসলিম)

* মসজিদে প্রবেশের পর নিরবতা অবলম্বন, মনোযোগ দিয়ে খুৎবা শোনা, অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থাকা-

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “জুমার দিন খুৎবা চলাকালে তুমি যদি তোমার সাথিকে শুধু বল যে চুপ কর, তাহলেও তুমি একটা বাজে কাজ করলে।” (বুখারী, মুসলিম)

* অন্যকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা-

আব্দুল্লাহ বিন বুসর (রাঃ) বলেন, “একদা জুমার দিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুৎবা দিচ্ছিলেন এমন সময় মানুষের কাঁধ ডিঙ্গিয়ে একটি লোক এগিয়ে এলো। রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেন, “তুমি বস, তুমি মানুষকে কষ্ট দিয়েছ।” (আবুদাউদ, নাসাঈ)

* জুম’আর আদব-

১. জুম’আর দিন গোসল করা। যাদের উপর জুম’আ ফরজ তাদের জন্য এ দিনে গোসল করাকে রাসুল (সাঃ) ওয়াজিব করেছেন (বুখারী)। পরিচ্ছন্নতার অংশ হিসাবে সেদিন নখ ও চুল কাটা একটি ভাল কাজ।

২. জুম’আর সালাতের জন্য সুগন্ধি ব্যবহার করা। (বুখারী)

৩. মিস্ওয়াক করা। (ইবনে মাজাহ, বুখারী)

৪. গায়ে তেল ব্যবহার করা। (বুখারী)

৫. উত্তম পোশাক পরিধান করে জুম’আ আদায় করা। (ইবনে মাজাহ)

৬. মুসুল্লীদের ইমামের দিকে মুখ করে বসা। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)

৭. মনোযোগ সহ খুৎবা শোনা ও চুপ থাকা- এটা ওয়াজিব। (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ)

৮. আগে ভাগে মসজিদে যাওয়া। (বুখারী, মুসলিম)

৯. সম্ভব হলে পায়ে হেঁটে মসজিদে গমন। (আবু দাউদ)

১০. জুম’আর দিন ও জুম’আর রাতে বেশী বেশী দুরুদ পাঠ। (আবু দাউদ)

১১. জুম’আর দিন বেশী বেশী দোয়া করা।। (বুখারী)

১২. মুসুল্লীদের ফাঁক করে মসজিদে সামনের দিকে এগিয়ে না যাওয়া। (বুখারী)

১৩. মুসুল্লীদের ঘাড় ডিঙ্গিয়ে সামনের কাতারে আগানোর চেষ্টা না করা। (আবু দাউদ)

১৪. কাউকে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে বসার চেষ্টা না করা। (বুখারী, মুসলিম)

১৫. খুৎবা চলাকালীন সময়ে মসজিদে প্রবেশ করলে তখনও ‘দু’রাকা’আত তাহিয়্যাতুল মাসজিদ’ সালাত আদায় করা ছাড়া না বসা। (বুখারী)

১৬. কেউ কথা বললে ‘চুপ করুন’ এটুকুও না বলা। (নাসায়ী, বুখারী)

১৭. ইমামের খুৎবা দেওয়া অবস্থায় দুই হাঁটু উঠিয়ে না বসা। (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)

১৮. খুৎবার সময় ইমামের কাছাকাছি বসা। জান্নাতে প্রবেশের উপযুক্ত হলেও ইমাম থেকে দূরে উপবেশনকারীরা বিলম্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (আবু দাউদ)

১৯. জুম’আর দিন সূরা কাহফ পড়া। এতে পাঠকের জন্য আল্লাহ তায়ালা দুই জুম’আর মধ্যবর্তী সময়কে আলোকিত করে দেন। (হাকেম, বায়হাকী)

* জুম’আর নামাজের ফযীলত ও তা আদায়কারীদের জন্য ঘোষিত পুরষ্কার-

১. কুরবানী করার সমান সওয়াব অর্জিত হয়-

দিনে আগে ভাগে মসজিদে গেলে দান-খয়রাত বা পশু কুরবানী করার সমতুল্য সওয়াব পাওয়া যায়। আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত এক হাদীসে রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যাক্তি জুম’আর দিন ফরজ গোসলের মত গোসল করে প্রথম দিকে মসজিদে হাজির হয়, সে যেন একটি উট কুরবানী করল, দ্বিতীয় সময়ে যে ব্যাক্তি মসজিদে প্রবেশ করে সে যেন একটি গরু কুরবানী করল, তৃতীয় সময়ে যে ব্যাক্তি মসজিদে প্রবেশ করল সে যেন একটি ছাগল কুরবানী করল। অতঃপর চতুর্থ সময়ে যে ব্যাক্তি মসজিদে গেল সে যেন একটি মুরগী কুরবানী করল। আর পঞ্চম সময়ে যে ব্যাক্তি মসজিদে প্রবেশ করল সে যেন একটি ডিম কুরবানী করল। অতঃপর ইমাম যখন বেরিয়ে এসে মিম্বরে বসে গেলেন খুৎবার জন্য, তখন ফেরেশতারা লেখা বন্ধ করে খুৎবা শুনতে বসে যায়।” [বুখারী]

২. মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে ফেরেশতারা অগ্রগামীদের নাম তালিকাভুক্ত করেন-

জুম’আর সালাতে কারা অগ্রগামী, ফেরেশতারা এর তালিকা তৈরি করে থাকেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “জুম’আর দিন মসজিদের দরজায় ফেরেশতা এসে হাজির হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে তারা সর্বাগ্রে আগমনকারীদের নাম লিখতে থাকে। প্রথম ভাগে যারা মসজিদে ঢুকেন তাদের জন্য উট, দ্বিতীয়বারে যারা আসেন তাদের জন্য গরু, তৃতীয়বারে যারা আসেন তাদের জন্য ছাগল, চতুর্থবারে যারা আসেন তাদের জন্য মুরগী, ও সর্বশেষ পঞ্চমবারে যারা আগমন করেন তাদের জন্য ডিম কুরবানী বা দান করার সমান সওাব্ব লিখে থাকেন। আর যখন ইমাম খুৎবা দেওয়ার জন্য মিম্বরে উঠে পড়েন ফেরেশতারা তাদের এ খাতা বন্ধ করে খুৎবা শুনতে বসে যান।” [বুখারী]

৩. দশ দিনের গুনাহ মাফ হয়-

জুম’আর দিনের আদব যারা রক্ষা করে তাদের দশ দিনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যাক্তি ভালভাবে পবিত্র হল অতঃপর মসজিদে এলো, মনোযোগ দিয়ে খুৎবা শুনতে চুপচাপ বসে রইল, তার জন্য দুই জুম’আর মধ্যবর্তী এ সাত দিনের সাথে আরও তিনদিন যোগ করে মোট দশ দিনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে খুৎবার সময় যে ব্যক্তি পাথর, নুড়িকণা বা অন্য কিছু নাড়াচাড়া করল সে যেন অনর্থক কাজ করল।” [মুসলিম]

৪. জুম’আর আদব রক্ষাকারীর দশ দিনের গুনাহ মুছে যায়-

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “জুম’আর সালাতে তিন ধরনের লোক হাজির হয়। (ক) এক ধরনের লোক আছে যারা মসজিদে প্রবেশের পর তামাশা করে, তারা বিনিময়ে তামাশা ছাড়া কিছুই পাবে না। (খ) দ্বিতীয় আরেক ধরনের লোক আছে যারা জুম’আয় হাজির হয় সেখানে দু’আ মুনাজাত করে, ফলে আল্লাহ যাকে চান তাকে কিছু দেন আর যাকে ইচ্ছা দেন না। (গ) তৃতীয় প্রকার লোক হল যারা জুম’আয় হাজির হয়, চুপচাপ থাকে, মনোযোগ দিয়ে খুৎবা শোনে, কারও ঘাড় ডিঙ্গিয়ে সামনে আগায় না, কাউকে কষ্ট দেয় না, তার দুই জুম’আর মধ্যবর্তী ৭ দিন সহ আরও তিনদিন যোগ করে মোট দশ দিনের গুনাহ খাতা আল্লাহ তায়ালা মাফ করে দেন।” [আবু দাউদ]

৫. প্রতি পদক্ষেপে এক বছরের নফল রোজা ও এক বছরের সারারাত তাহাজ্জুদ পড়ার সওয়াব অর্জিত হয়-

যে ব্যাক্তি আদব রক্ষা করে জুম’আর সালাত আদায় করে তার প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে তার জন্য পুরো এক বছরের রোজা পালন এবং রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়ার সওয়াব লিখা হয়।

আউস বিন আউস আস সাকাফী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “জুমা’আর দিন যে ব্যাক্তি গোসল করায় (অর্থাৎ সহবাস করে, ফলে স্ত্রী ফরজ গোসল করে এবং) নিজেও ফরজ গোসল করে, পূর্বাহ্ণে মসজিদে আগমন করে এবং নিজেও প্রথম ভাগে মসজিদে গমন করে, পায়ে হেঁটে মসজিদে যায় (অর্থাৎ কোন কিছুতে আরোহণ করে নয়), ইমামের কাছাকাছি গিয়ে বসে, মনোযোগ দিয়ে খুৎবা শোনে, কোন কিছু নিয়ে খেল তামাশা করে না; সে ব্যাক্তির প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য রয়েছে বছরব্যাপী রোজা পালন ও সারা বছর রাত জেগে ইবাদত করার সমতুল্য সওয়াব।” [মুসনাদে আহমাদ]

৬. দুই জুম’আর মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহের কাফফারা-

জুম’আর সালাত জুম’আ আদায়কারীদের জন্য দুই জুম’আর মধ্যবর্তী গুনাহের কাফফারা স্বরূপ। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “পাঁচ বেলা সালাত আদায়, এক জুম’আ থেকে পরবর্তী জুম’আ, এক রমজান থেকে পরবর্তী রমজানের মধ্যবর্তী সময়ে হয়ে যাওয়া সকল (সগীরা) গুনাহের কাফফারা স্বরূপ, এই শর্তে যে, বান্দা কবীরা গুনাহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে।” [মুসলিম]

আজকের বাজার/ এমএইচ