দিনাজপুরে ৫টি দিঘী : জুলুমসাগর দিঘীর পাড়ে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি

জেলা শহর ও সদর উপজেলা এলাকায় একসাথে পাঁচ পাঁচটি সাগর, তথা রাজদিঘী রয়েছে। যা সারা বছর দর্শনার্থীদের পদ চারণায় মুখরিত থাকে। স্বাধীনতার এ মাসে জুলুম সাগর পাড়ে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভব নির্মাণের দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী  ।
সম্প্রতি দিনাজপুর বাসী ও সুধী জনের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের দাবি এসব সাগরের নামে দিঘিগুলোর ঐতিহাসিক নিদর্শন সরকারিভাবে দেখাশোনা ও নিয়ন্ত্রণ না থাকায সাগর গুলোর   জৌলুস হারিয়ে যেতে বসেছে।
দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মোঃ রুহুল আমিন জানান, মোগল সম্রাটের শাসনামলে দিনাজপুর সদর উপজেলায় দিঘীর আকৃতি এসব ৫ টি সাগর তৎকালীন দিনাজপুরের রাজা ও তার অংশীদারীরা এ এলাকার জনসাধারণের পানির চাহিদা মিটানোর জন্য বিশাল ভূমিতে খনন করে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করেছিলেন। এসব সাগরে সে সময়ের মানুষ পরিবারের লোকজন গোসলসহ খাবার পানির চাহিদা পূরণ করতো।
খরোতাপ ও গরম মৌসুমে গবাদি পশু ও ছাগলদের এসব সাগরে গোসল করানো হতো। সব মিলিয়ে এ ৫ টি সাগর দিনাজপুর সদর উপজেলা পানির চাহিদা পূরণ করত।
সাগরের বৈশিষ্ট্য ছিল সাগরের চতুষ্পাশে জন সাধারণের বসার জন্য মনোমুগ্ধকর ঘাট নির্মাণ করা হয়েছিল। এসব ঘাটের দু’পাশে শানবাদায় করা ছিল। সাগরে নামার জন্য পাকা সিড়ি নির্মাণ করা হয়েছিল। ওই সিড়ি দিয়ে গোসল করার জন্য জনসাধারণ সাগরে নামতো। মনোমুগ্ধকর পরিবেশে সকলেই গোসল করে তৃপ্তি সহকারে বাসায় ফিরত। এসব সাগরে গোসল করে সকলেই তৃপ্তি পেত।
এখন আধুনিক তোদের ছোঁয়ায় এসব সাগরে গোসল আর হয় না, মাছ চাষের ব্যবস্থা চলছে। তারপরে অনেক যুবক শখের বশে এ সাগর গুলোতে গোসল করে থাকে। পিকনিকের মৌসুম গুলোতে দূরদূরণ থেকে আগত দর্শনাথীরা মনের আনন্দে গোসল করে  ফিরে যায়।
তিনি বলেন পর্যটকের আওতাভুক্ত করে এ ৫টি সাগরকে ব্যবহৃত করা হলে প্রতিবছর এসব সাগরগুলো থেকে বেশ অংকের একটি রাজস্ব আদাই করা সম্ভব হবে।
তিনিসহ বঙ্গবন্ধু পরিষদের অনেক প্রবীণ শিক্ষার্থী দিনাজপুর জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শিক্ষক শফিকুল, সাবেক রংপুর বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক ডাক্তার আব্দুল আহাদ, ও জেলা স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ডাক্তার শহিদুল ইসলাম খান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও চিকিৎসক ডাক্তার এটিএম জিল্লুর রহমানসহ অনেকেই দিনাজপুর এ টি পাঁচটি দীঘি প্রকৃতির সাগরকে  খাস  দখালে অবহেলায় না রেখে  পর্যটনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হলে এ খাত থেকে মোটা অংকের রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হবে।
দিনাজপুর বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতৃবৃন্দের  অভিমত,  পলাশীর যুদ্ধের কিছুদিন আগে মহারাজা রামনাথ (১৭৫০-৫৫) খনন করেছিলেন মানবসৃষ্ট দিঘী ঐতিহাসিক রামসাগর। ৭৭ একরের এ দৈত্যাকৃতি দিঘী নিয়ে আজ মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। দিনাজপুর শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে তাজপুর গ্রামে  এটি অবস্থিত৷

রামসাগরের নাম যারা জানেন, তারা অনেকেই জানেন না, রামসাগরের প্রাচীন দিঘী সুখসাগর ও মাতাসাগর। এ দিঘী দুটো খনন করেন মহারাজা সুখদেব। গত ১৬৭৭ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে ‘মহারাজ’ উপাধি পাওয়ার পর তিনি দিঘী দুটো খননের উদ্যোগ নেয়৷ রাজবাটীর ১০০ মিটার পেছনে ২২ একরের সুখসাগর দিঘীটি তাঁর নামে৷  এটি বর্তমানে ইকোপার্ক করা হয়েছে।
সুখসাগরের পাশে আরেক বিরাট আকারে দিঘী খনন করে মহারাজ সুখদেব, এটি তাঁর মায়ের নামে উন্মুক্ত করেন। এর নাম হয় মাতাসাগর। ৪৫ একরের মাতাসাগর সূর্যাস্তের রাণী হয়ে ওঠে। টিলায়-বনে-পাখ-পাখালিতে হারিয়ে যায় শহুরে কোলাহল। দুর্ভাগ্যবশত, অরক্ষিত হওয়ায় এ দিঘীটির পাড় কেটে নেয়া হচ্ছে বহুবছর ধরে ।  সুখসাগর ও মাতাসাগরের মাঝে ৩০০ বছরের সংযোগ রাস্তাটি এখন কেটে জমি বানানো হয়েছে।
রাজা রামনাথ সস্ত্রীক সুখসাগর থেকে আনন্দ ভ্রমণে আসতেন বলে ৭ একরের দিঘীটির নাম পড়ে ছিল “আনন্দসাগর”। এটি  বর্তমানে দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালের  পাশে অবস্থিত। এ দুই সাগরের একটি সংযোগ খাল ছিল, যা এখনো আছে, তবে নগর বাসীর বর্জ্যের অত্যাচারে নালায় পরিণত হয়ে সংযোগ হারিয়েছে। অরক্ষিত আনন্দ সাগরকে দখল করার চেষ্টা হচ্ছে বহুদিন থেকে  ।
দিনাজপুর গোড় এ শহীদ বড়মাঠের সম্মুখে অবস্থিত  সার্কিট হাউস এলাকায় বিজিবির কৃষ্ণকলি ক্যাফের সাথে “জুলুমসাগর”। ৮৪৫ বিঘার এ দিঘীর নাম করণে রয়েছে ভিন্ন ইতিহাস।ইংরেজদের অকথ্য নির্যাতনে শহীদ শত শত লাশ ফেলা হয়েছে এ দিঘীতে ৷ সে ধারা বজায় রেখে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদাররা বদ্ধভূমি বানিয়ে অসংখ্য মানুষ হত্যা করে শহীদের মৃত্যু দেহ ফেলেছে  জুলুম সাগরে।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও সে সময় পাক বাহিনীদের নির্মম নির্যাতন  অত্যাচারে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দিনাজপুর শহরের এ জুলুম সাগর। কিছুদিন আগে এখানে মাছ শিকার করতে গিয়ে জেলেরা মানুষের হাড়গোড় ও মাথার খুলি পেয়েছে। এখনো জুলুম সাগর থেকে জেলেদের জালে মানুষের হাড়গোড় ও মাথার খুলি চিহ্ন পাওয়া যাওয়ার  সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য ওইসব অত্যাচারী নির্যাতনে শহীদদের এ জুলুম সাগর বদ্ধভূমিতে কোন স্মৃতি সংরক্ষণের  জন্য বধ্যভূমি নির্মাণ করা হয়নি। তবে তাদের দাবি এখানে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ   নির্ণয় করা। তবে ওইসব শহীদদের আত্মার শান্তি পাবে।
এছাড়াও রাজা প্রাণনাথের খননকৃত প্রাণসাগর, যা ছিলো শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরেই, মানচিত্রের কাটাকুটিতে সেটি এখন পশ্চিম বঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর কুমারগঞ্জ থানার অংশের সম্পত্তি পড়েছে।