পরিকল্পিত ছিল ফেনীর প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ তৎকালীন সিও অফিসে পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের ওপর সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করে ফেনীর মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা, পুলিশ, ইপিআর এর অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সদস্যদের নিয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনী।

তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগ সভাপতি খাজা আহমদের নেতৃত্বে তিনদিনের এ যুদ্ধ মুক্তিকামী জনতার তাৎক্ষণিক আবেগের কোন বিষয় ছিল না। এটি ছিল একটি পরিকল্পিত প্রতিরোধ যুদ্ধ। এটিই ফেনী হতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে নিহত হয় মতান্তরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ফারুকীসহ ১৭ সেনাসদস্য।

মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ : নোয়াখালী জেলা গ্রন্থে দেখা যায়, আগের দিন ২৬ মার্চ নোয়াখালী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মনযূর উল করীম, পুলিশ সুপার আবদুল হাকিমের সাথে জরুরী সভা করেন নোয়খালী জেলা সংগ্রাম পরিষদ। এ পরিষদের অন্যতম সদস্য ছিলেন খাজা আহমদ। এ সভায় নোয়াখালী জেলা পুলিশের তৎকালীন একাধিক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভার একটি গোপন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিটি থানার অস্ত্রাগার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এসময় ফেনী থানার ওসি ছিলেন মোহাম্মদ আলী। এ প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন (ভিপি জয়নাল) জানান, সিও অফিস যুদ্ধে ফেনী থানার অস্ত্রগুলো ব্যবহৃত হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে।

সুদক্ষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে এমন যুদ্ধে জয় পাওয়া প্রায় অসম্ভব ধারণা করা হলেও পিছপা হননি খাজা আহমদ। ২০১৭ সালে ফেনী জেলা প্রশাসন প্রকাশিত একাত্তরের ফেনী ম্যাগাজিনে বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম এবিএম তালেব আলী নিজের একটি লেখায় ফেনীতে প্রথম যুদ্ধ প্রসঙ্গে কিছু স্মৃতিকথা উল্লেখ করেন। পাকিস্তানি আর্মিদের ঘেরাও ও আক্রমণ প্রসঙ্গে তিনি মরহুম খাজা আহমদের অসীম সাহসিকতার কথা উল্লেখ করেন।

তিনি উল্লেখ করেন, ‘খাজা আহমদ বলেন, জনতাকে সঙ্গে নিয়ে পাক সৈন্যদের আক্রমণ করতে হবে। নিজেদের সামর্থ্যের কথা মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু আমাদের বাঁচার কোন উপকরণ নেই। হারি বা জিতি আক্রমণ চালাতেই হবে। জনতার উচ্ছ্বাস ও সংগৃহীত কয়েকটি রাইফেল, স্টেনগান, কতিপয় আর্মি, ইপিআর, মারমুখো জনতা নিয়েই আক্রমণ করবো’।

মুক্তিযুদ্ধে ২ নং সাব সেক্টর কমান্ডার জাফর ইমাম এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ভূমিকা প্রসঙ্গে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে নোয়াখালীতে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে আবদুল মালেক উকিল, খাজা আহমদ, নুরুল হক মিয়া, অধ্যাপক মোহাম্মদ হানিফ, শহীদ উদ্দিন ইস্কান্দার প্রমুখ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ডাকে সাড়া দিয়ে পুলিশ বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের মধ্যে জেলা পুলিশ সুপার আবদুল হাকিম, সিআই লুৎফর রহমান চৌধুরী, ডিআইও ওয়ান আশরাফ আলী চৌধুরী, আর আই ছদ্রতুল্লাহ খান চৌধুরী, ফেনীর ওসি মোহাম্মদ আলীর নাম উল্লেখযোগ্য।

এ যুদ্ধে অংশ নেয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা হারাধন বণিক জানান, সীমান্ত এলাকা থেকে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা এসে যোগ দেয় এ যুদ্ধে। একাধিক সূত্রে পাওয়া যায়, ২৭ মার্চ সিও অফিসে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধের সময় ইপিআরের শালধর বাজার হতে নায়েব বাদশা মিয়া তার প্লাটুনের সদস্যদের সাথে নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। একই সময় যোগ দেন ইপিআরের নায়েব আফতাব উদ্দিন ও তার প্লাটুনের সদস্যরা।

আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ উল্লেখ করেন, ২৮ মার্চ ১৫জন ছাত্র-বন্ধুসহ এ যুদ্ধে যোগ দেই। এ যুদ্ধের পরিকল্পনায় নোয়াখালী হতে পুলিশ সদস্যদের আনা হয়। সীমান্ত থেকে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের আনা হয়। প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করে স্থানীয় ছাত্র-জনতা। যুদ্ধজয়ের পেছনে তীক্ষ্ণ রণকৌশল।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব জানান, পরিকল্পনাকারীদের বুদ্ধিমত্তায় প্রথম যুদ্ধেই আমরা জয়লাভ করি। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ইপিআর অবসারপ্রাপ্ত কর্মককর্তা আবু আহাম্মদ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ২৩ নম্বর আসামী ফ্লাইট সার্জেন্ট শামছুল হক, অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন আবদুর রউফ, শামছু ব্যাটালিয়ন ছিলেন।

ইতোপূর্বে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ফেনী সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সদ্য প্রয়াত আবদুর রহমান বিকম জানিয়েছিলেন, ২৮ মার্চ সারাদিন পাকিস্তানি আর্মিদের মাইকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হলেও তারা আত্মসমর্পণ করেনি। বরং পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। এরপর রাতে খড়ের আগুন দিয়ে ধোঁয়া তৈরি করে ও পাল্টা গুলিবর্ষণ করা হয়। এ যুদ্ধে পাঁচ পাকিস্তানি আর্মি নিহত হয়। অন্যরা ধরাপড়ে, জনতা তাদের পিটিয়ে মারে। প্রথম সম্মুখ সমরে ফেনীতে মুক্তিযোদ্ধারা জয়ী হয়।

আবদুল মোতালেব বলেন, প্রায় দুইরাত দুইদিন এখানে কৌশলগত ও থেমে-থেমে যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে মুলত অংশ নেন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও ইপিআর সদস্য। এর সাথে ওতোপ্রতোভাবে যুক্ত ছিল ছাত্র জনতা। সমগ্র পরিকল্পনায় ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা খাজা আহমদ। মূলত তার অসীম সাহস আর বুদ্ধিমত্তায় প্রথম যুদ্ধেই আমরা জয়লাভ করি।

এ যুদ্ধ প্রসঙ্গে স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী ভীতসন্তস্ত্র পাকিস্তানি হানাদারদের বেপরোয়া গুলিতে চারজন সাধারণ মানুষ নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে হানাদারদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন বলে জানা যায়। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ : নোয়াখালী জেলা গ্রন্থে দেখা যায়, শহীদদের একজন ছিলেন পুলিশ কনস্টেবল মো. মনিরুল হক। এ বিবেচনায় মনিরুল হক যুদ্ধে শহীদ ফেনীর প্রথম বীর মুক্তিযোদ্ধা।

একই সূত্রে দেখা যায়, শহীদ মনিরুল হক (কনস্টেবল/১৫৯) ছিলেন নোয়াখালী পুলিশ লাইনের একজন রিজার্ভ সদস্য। ২৭ মার্চ তিনি সিও অফিস যুদ্ধে শহীদ হন। তার গ্রামের বাড়ি ছিল কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বারের সূর্যপুর গ্রামে (ডাকঘর: সাহারপাড়)। তবে তিনি কিভাবে শহীদ হয়েছিলেন তা বিস্তারিত উল্লেখ পাওয়া যায়নি। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান