বামীর ব্যবসা বাচাতে গলার হার বেচে দেন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর মেয়ে

ইতিহাস না ঘেটেও যে তথ্যটি জোর দিয়ে বলা যায়, সেটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারতের সাফল্যের সিংহভাগই এসেছে মাত্র একটি কোম্পানির হাত ধরে। কাগজে-কলমে এটি একটি প্রতিষ্ঠান হলেও এর ব্যাপকতা একে বাণিজ্যের মহলে পরিচিত করেছে এক ‘সাম্রাজ্য’ হিসেবে, যা একটু একটু করে গড়ে উঠেছে গত দু’শতাব্দী ধরে, ভারতে একের পর এক শিল্পের গোড়াপত্তন করার মাধ্যমে। হ্যাঁ, বলছি টাটা গ্রুপের কথা।

তবে আজকের এই অবস্থানের পেছনে যে মানুষটির অবদান অনেক বেশি তিনি মেহরবাই টাটা। বিজ্ঞানী হোমি ভাবার কন্যা ছিলেন এই মেহরবাই। অন্যদিকে কোম্পানি যার নামে তার স্বামী ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। সূত্রটা এতক্ষণে মিলিয়ে ফেলেছেন নিশ্চয়? ব্যবসার উদ্দেশে বেঙ্গালুরু গিয়ে বিজ্ঞানীর বাড়ি গিয়ে মেয়ে মেহরবাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। প্রথম দেখাতেই মেহরবাইকে ভালো লেগে গিয়েছিল। বলা যায় ভালোবেসে ফেলেছিলেন তিনি। এর কিছু দিন পরই ছেলে দোরাবজিকে বেঙ্গালুরুতে ভাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন মেহরবাইয়ের সঙ্গে আলাপ করার জন্য।

প্রথম দেখাতেই মেহরবাইকে ভালো লেগে গিয়েছিল দোরাবজি

মেহরবাইকেই পরিবারের বড় বউ করে ঘরে তুলেছিলেন জমশেদজি। জমশেদজির মনের মতো করে, নিজের শিক্ষা এবং সংস্কৃতি দিয়ে পরিবারকে আগলে রেখেছিলেন মেহরবাই। পরিবারের প্রতি এবং স্বামীর প্রতি এতটাই দায়বদ্ধ ছিলেন যে নিজের পছন্দের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটিও পরিবারের স্বার্থে বেচে দিয়েছিলেন।

জুবিলি হীরা কোহিনূরের দ্বিগুণ বড় আর দামও বিপুল। ভালোবেসে স্ত্রীর জন্য বহুমূল্য এই হিরের আংটি কিনে দিয়েছিলেন দোরাবজি। মাত্র কয়েক বার সেটি পরেছিলেন মেহরবাই। খুব পছন্দের অলঙ্কার ছিল সেটি। তাই সচরাচর পরতেন না। এই আংটিই বেচে দিয়ে স্বামীর হাতে টাকা তুলে দিয়েছিলেন তিনি।

বিজ্ঞানী হোমি ভাবার মেয়ে ছিলেন মেহেরবাই

১৮৯৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি খনি থেকে এই হিরে পাওয়া গিয়েছিল। লন্ডনের এক হিরে ব্যবসায়ীর অধীনে সেটি ছিল। তার থেকে পর্তুগালের রাজা প্রথম কার্লোস সেটি স্ত্রীর জন্য কিনেছিলেন। ১৯০০ সাল নাগাদ এই হিরেটি হাতবদল হয়ে প্যারিসের একটি প্রদর্শনীতে দেখানো হয়। সেখান থেকেই স্ত্রীর জন্য এটি কিনে নিয়েছিলেন দোরাবজি।

টাটাদের ব্যবসা সে সময় ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। একাধিক ব্যবসায় হাত লাগাতে শুরু করেছিল গোষ্ঠী। কিন্তু ১৯২৪ সাল নাগাদ ব্যবসায় বড় মাপের ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। প্রচুর ধার হয়ে গিয়েছিল ব্যাংকের কাছে। ধার শোধ করে ব্যবসা বাঁচানোর উপায় বাতলে দিয়েছিলেন মেহরবাই। উপহার পাওয়া ওই জুবিলি হীরার আংটি বেচে ধার শোধ করেছিলেন তিনি।

মেহরবাইকেই পরিবারের বড় বউ করে ঘরে তুলেছিলেন জমশেদজি

স্বামী দোরাবজির মতো তার নাম সকলের কাছে পরিচিত নয়। কিন্তু এক সময় নিজের গুণেই দেশ-বিদেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তিনি। আভিজাত পরিবারে জন্ম এবং বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও মানুষের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ করতেন না মেহরবাই। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে নিমেষে মিশে যেতে পারতেন। অনাহারে দিন কাটানো কোনো দরিদ্র মানুষের কথা শুনলে নিজে হাতে তার খাবারের ব্যবস্থা করে দিতেন।

অত্যন্ত স্বাধীনচেতা মানসিকতার মানুষ ছিলেন তিনি। এই মানসিকতা অবশ্য বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন বলে বহু বার জানিয়েছিলেন তিনি। নিজের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে যেমন শিখিয়েছিলেন, তেমনই কোনো রকম কুসংস্কার কিংবা পিছিয়ে থাকা মানসিকতা বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পাঠ দিয়েছিলেন মেয়েকে।

দোরাবজি জুবিলি হীরা স্ত্রীর জন্য কিনে নিয়েছিলেন

নারীদের উপর কোনো নির্যাতন মেনে নিতে পারতেন না মেহরবাই। পর্দা প্রথা রোধ, বাল্যবিবাহ রোধ, নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো-সবেতেই তার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। দেশের বাইরেও এই সমস্ত বিষয়ে সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন তিনি। ভারতীয় রেড ক্রস সোসাইটির সদস্যও ছিলেন তিনি। মেহরবাই শুধু ভাল মানুষ ছিলেন না, তিনি ভাল খেলোয়াড়ও ছিলেন। টেনিস খেলতে খুব ভালোবাসতেন। স্বামীর সঙ্গে উইম্বলডন দেখতে যেতেন। আর ভালবাসতেন পিয়ানো বাজাতে। তিনি এক জন দক্ষ ঘোড়সওয়ারও ছিলেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি বিমানে উঠেছিলেন। ১৯১২ সালে জেপলিন এয়ারশিপ-এ উঠেছিলেন তিনি।

নিঃসন্তান ছিলেন এই দম্পতি

১৯৩১ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় মেহরবাইয়ের। স্ত্রীর কষ্ট খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন স্বামী দোরাবজি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাই লেডি টাটা মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গড়ে তোলেন তিনি। রক্তের বিভিন্ন রোগ নিয়ে গবেষণা করাই ছিল এর কাজ। মেহরবাইয়ের মৃত্যুর এক বছর পর দোরাবজিরও মৃত্যু হয়। তবে নিঃসন্তান ছিলেন এই দম্পতি। মৃত্যুর আগে নিজের সিংহভাগ সম্পত্তি দিয়ে স্যার দোরাবজি টাটা ট্রাস্ট গড়ে তুলেছিলেন তিনি। বেঙ্গালুরুতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সও গড়ে তুলেছিলেন। তথ্য-ডেইলি বাংলাদেশ

আজকের বাজার/আখনূর রহমান