রক্তাক্ত মাতমহীন তাজিয়া মিছিলে আশুরা উদযাপিত

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যথাযোগ্য ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের মধ্যদিয়ে পালিত হচ্ছে শোকাবহ আশুরা। ৬১ হিজরীর ১০ মহররম কারবালার প্রাঙ্গণে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদের শাহাদাতের দিনটি মুসলিম বিশ্বে ত্যাগ ও শোকের দিন হিসেবে পালিত হয়। এ উপলক্ষ্যে শিয়া সম্প্রদায়ের আশুরার পালনের প্রধান অনুষঙ্গ তাজিয়া মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।

প্রতি বছরের মতো এবারো ঢাকাসহ হোসেনি দালান থেকে কারবালার মর্মান্তিক শোকের স্মরণে হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে তাজিয়া মিছিল শুরু হয়। ১ অক্টোবর, রোববার সকাল ১০টার দিকে বের হওয়া মিছিলটির আয়োজক ‘হোসেনি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’। তাজিয়া মিছিলটি বকশীবাজার রোড, নিউ মার্কেট হয়ে ধানমন্ডি লেকে গিয়ে শেষ হয়। ঢাকা ও এর আশপাশের লোকজন এই মিছিলে অংশ নেন।

এদিকে হোসেনি দালান রোডের ইমামবাড়া থেকে আরেকটি মিছিল বের হয়ে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর ও মিরপুরেও তাজিয়া মিছিল বের করা হয়্। এবারের মিছিলে রক্তাক্ত মাতম ছিল না।

এবারের মিছিলে ছুরি-কাঁচি, তলোয়ার, জিঞ্জির নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল পুলিশ প্রশাসন। তাই কোনো মিছিলে অন্যবারের মতো ছুরির গুচ্ছ দিয়ে পিঠে আঘাত করতে করতে রক্তাক্ত মাতম করতে দেখা যায়নি। প্রতিটি মিছিলের সামনে ও পেছনে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও র‌্যাবের সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। হোসেনি দালানে প্রবেশের সময়ও কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে মানুষকে। দালানের আশপাশে সিসিটিভি চোখে পড়ে।

২০১৫ সালের আশুরার রাতে হোসেনি দালানে বোমা হামলার ঘটনার পর থেকে তাজিল মিছিল ও হোসেনি দালান এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ব্যভস্থা নেয়া হয়। ওই হামলায় নিহত হয় একজন ও আহত হয় অনেকে।

তাজিয়া মিছিল সাজানো হয় কারবালার শোকের নানা প্রতিকৃতি দিয়ে। হযরত ফাতেমা (সা. আ.)-এর স্মরণে মিছিলের শুরুতেই দুটি কালো গম্বুজ বহন করা হয়। তাজিয়া তৈরি করা হয়েছে ইমাম হোসাইনের মাজারের আদলে। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা অনেকেই বিভিন্ন নিশান নিয়ে আসেন। বেশিরভাগ মানুষের পরনে ছিল কালো পোশাক।

এর আগে সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে যোগ দিয়েছেন। মূল তাজিয়া মিছিলে যোগ দিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কালো কাপড় পড়ে হোসেনি দালানে আসতে থাকেন। নিরাপত্তা বিবেচনায় মিছিলে অংশ নিতে ইচ্ছুক প্রত্যেককে পুলিশের তল্লাশি চৌকির মধ্য দিয়ে যেতে দেখা যায়।

রাজধানীর পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের বিবিকা রওজা, পুরানা পল্টন, মগবাজার, মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প ও মিরপুর-১১ নম্বরে বিহারি ক্যাম্পগুলোয় আশুরা পালিত হয়। এসব এলাকাগুলোতেও নিরাপত্তা জোরদার করেছে ডিএমপি।

রাজশাহীতে পালিত হচ্ছে আশুরা
আশুরা উপলক্ষে বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন সকালে রাজশাহী মহানগরীর সাহেব বাজার জিরোপয়েন্ট, দরগাপাড়া, শিরোইল কলোনি ও উপশহর এলাকা থেকে তাজিয়া মিছিল বের করে। মিছিলে অংশগ্রহণকারী মুসলমানরা কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (আ.) এর শাহাদাতের ঘটনা স্মরণে ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ ধ্বনিতে শোক মাতম করেন।

খুলনায় তাজিয়া মিছিলআশুরা উপলক্ষে খুলনায় তাজিয়া মিছিল হয়। সকাল ১০টায় খুলনা মহানগরীর আলতাপোল লেনের আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানি ট্রাস্ট ইমাম বাড়ি থেকে তাজিয়া মিছিল বের হয়। মিছিলে অংশ নেয়া শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সবাই একত্রে শোক প্রকাশ করতে থাকেন। মিছিলটি নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে ফের ইমাম বাড়িতে গিয়ে শেষ হয়।

শোক মিছিলপূর্ব সমাবেশে ইসলামি শিক্ষা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহীম খলীল রাজাভী বক্তৃতা করেন।

এ সময় তিনি বলেন, শোক আলোচনা ও শোক মিছিলের মূল উদ্দেশ্য হলো বিশ্ববাসীকে এ বার্তা পৌঁছে দেওয়া যে, শিয়া মুসলমানরা জালিমদের পক্ষে নয়, তারা মজলুমদের পক্ষে। ইসলামকে রক্ষা করতে গিয়ে নবীর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন পরিবার-পরিজন ও সঙ্গি-সাথী নিয়ে ৬১ হিজরিতে কারবালার প্রান্তে নির্মমভাবে শাহাদৎ বরণ করে যে মহান আত্মত্যাগের নির্দশন রেখে গেছেন, সেই মহান আত্মত্যাগ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।

তিনি বলেন, বিশ্বের মুসলমানরা আজ যদি মজলমুদের পক্ষে অবস্থান নিতো তাহলে আইএস তথা ইসলামের নামে অন্য জঙ্গি ও সন্ত্রাসী দল সৃষ্টি হতো না। তারা আজ ইসলামের নামে বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের মসজিদ ও ধর্মীয় স্থাপনায় আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে মুসলমান নারী-পুরুষ-শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করছে।

কারবালার ঘটনা থেকে তিনি শিক্ষা নিয়ে নবী (সা.) এর দৌহিত্র, বেহেশতের যুবকদের নেতা ইমাম হোসাইন-এর আদর্শ বুকে ধারণ করে মজলুমদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার আহবান জানান।

হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালার ফোরাত নদীর তীরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শাহাদত বরণ করেন। এই শোক ও স্মৃতিকে স্মরণ করে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে পবিত্র আশুরা পালিত হচ্ছে। দিনব্যাপী এই কর্মসূচির মধ্যে আছে তাজিয়া মিছিল, বিশেষ মোনাজাত, কোরআনখানি, দোয়া ও মাহফিল। অনেকে দিবসটি উপলক্ষে নফল রোজাও রাখছেন। দরিদ্র মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণও করে থাকে অনেক পরিবার।

আজকের বাজার:এলকে/এলকে/ ১ অক্টোবর ২০১৭