হাথুরুসিংহের শ্রীলঙ্কাকে গুঁড়িয়ে দিল টাইগাররা

এটা কি কোনো প্রতিশোধ? বাংলাদেশ দলের পক্ষ থেকে? নাকি প্রকৃতির বিচার? সেই যে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের মাঝপথে চন্ডিকা হাথুরুসিংহের পদত্যাগ, পরে জানাজানি। শত অনুরোধেও ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত থাকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে নিজ দেশের প্রধান কোচের দায়িত্ব নিতে ছুটে যাওয়া। মাশরাফিদের জিজ্ঞেস করুন। কেউ মুখে বলবেন না। তারপরও এটাই কিন্তু নির্মম প্রতিশোধে হাথুরুসিংহের বিরুদ্ধেই শুরু তাদের, যতোটা না শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। কিন্তু মনের গহীন থেকে অস্বীকার করতে পারবেন সাকিবরা? অন্তত টাইগার ক্রিকেটপ্রেমীরা তো আসলে শ্রীলঙ্কাকে এভাবে জিম্বাবুয়ের চেয়ে বাজেভাবে গুঁড়িয়ে দিয়ে হারানোকে হাথুরুসিংহের ওপর তুলে নেওয়া শোধই বলবেন! ত্রিদেশীয় সিরিজে স্বাগতিক বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম দেখায় কোনো বিভাগেই যে টাইগারদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেই পারলো না লঙ্কানরা!

হারের ব্যবধানটা ১৬৩ রানের। শ্রীলঙ্কা দলে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ স্কোর ২৯। এরপর ২৮ ও ২৫ এর পর তেমন কিছু বলার নেই। ৩২.২ ওভারে ১৫৭ রানে অল আউট। যেখানে জিম্বাবুয়ে ৪৯ ওভার খেলে ১৭০ রান করতে পেরেছিল! এক হিসেবে টানা দুই ম্যাচে জিতে বাংলাদেশ কিন্তু ফাইনালেই উঠে গেল! টানা দুই ম্যাচে বোনাস পয়েন্টসহ জেতায় ১০ পয়েন্ট তাদের। বাকি দুই দলের তাই একে অন্যের সাথে লড়াই করেই এই টুর্নামেন্টের ফাইনালে স্বাগতিকদের প্রতিপক্ষ হতে হবে।

কিভাবে? দুই দলের মধ্যে কেবল একটিরই পক্ষে সম্ভব হবে বোনাস পয়েন্টসহ বাকি ম্যাচ জিতলেও ১০ পয়েন্টে যাওয়া। আর একটি তথ্য না জানালেই নয়। তাতে অবিচার হয় টাইগারদের ওপর। তাদের বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষমাহীন নির্দয় ও নিষ্ঠুরতার জয়ের সাফল্যেও। এই জয়ই কিন্তু বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জয়। রানের ব্যবধানে। আগের সবচেয়ে বড় জয়টি ছিল ১৬০ রানের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।

মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে এদিন সবকিছুই গেছে টাইগারদের ভয়ডরহীন আগ্রাসী ক্রিকেটের পক্ষে। টসও। কেবল ব্যাটিংয়ের শেষের দিকে একটু ঝামেলা হলো। নইলে বলা যেত নিপুণ খেলাই খেলেছে বাংলাদেশ। শেষ ১০ ওভারে ৪ উইকেট হারানো ও ৭৭ রান, ওটা ঠিক তার আগের ৪০ ওভারের সাথে যায়নি। শীর্ষ পাঁচের কেউ শেষ পর্যন্ত থাকলে রানটা যে দেশের আগের সর্বোচ্চ ৩২৯ রানকেও ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল।

কিন্তু তাতে আক্ষেপের কিছু নেই মোটে। কথায় কথায় লোকে বলে ‘ছেলেখেলা’ নাকি! এখন এই ম্যাচে মাশরাফিরা যা করলেন হাথুরুসিংহের দলকে নিয়ে তাতে ওই উপমাটাই মানায় বেশি। যে ম্যাচে সাকিবের ৬৩ বলে ৬৭ এবং ৮ ওভারে ৪৭ রানে ৩ উইকেট সাবেক কোচকে জবাব দেওয়ার মতোই বটে। দেশের বোর্ড প্রেসিডেন্টের কথায় (যদিও অস্বীকার করেন হাথুরু) জানা গিয়েছিল, কোচের আচমকা দেশ ছাড়ার অন্যতম কারণ সাকিব। এই ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় বিশ্বের সেরা অল রাউন্ডারই। তবে সাকিবের নিশ্চয়ই আগের ম্যাচের চেয়ে এই খেলার সেরার পুরস্কারটি অন্যরকম তৃপ্তি দেবে।

জিম্বাবুয়ের কাছে হেরে চাপে পড়া শ্রীলঙ্কার মান বাঁচানোর জন্যও জেতা খুব দরকার ছিল। কিন্তু শিরোপার দিকে একচোখ দিয়ে রাখা টাইগাররা আগে তাদের পাহাড়ে চাপা দিল। রানের হিমালয় পরে প্রমাণিত সেটি। পরে নাসির হোসেনকে দিয়ে বোলিংয়ের শুরু। ইনিংসের তৃতীয় ওভারে নাসির শিকার করেন ইনফর্ম কুশল পেরেরাকে (১)। জয়োৎসবের ওখানেই শুরু। টানা ৮ ওভারের স্পেল মাশরাফি এরপর করেন অন্য প্রান্ত থেকে। প্রথমটি মেডেন। আর এরপর তিনি তুলে নেন বিপিএলের দারুণ পারফর্মার উপুল থারাঙ্গার (২৫) সাথে কুশল মেন্ডিসকে (১৯)। টপ অর্ডার ভাঙতে থাকে। চাপ বাড়ে। ১৩তম ওভারে ছন্দে ফেরা কাটার মাস্টার এবং ১৮তম ওভারে সাকিব আল হাসানের বোলিংয়ে আসা, মাঝে রুবেলে হোসেনের চার ওভার, বোঝা যায় দারুণ আত্মবিশ্বাসী অধিনায়ক এখন ঠিক ক্ষণে ব্যকরণগত পরীক্ষার সাথে সব পরীক্ষার বিলাসিতাই করতে পারেন। বাংলাদেশ দলটিই যে এমন এখন!

এবং এসব কাজে মাশরাফি দারুণ সফল। কাটার মাস্টার ‘ফিজ’ যখন নিরোশান ডিকভেলাকে (১৬) বুদ্ধু বানিয়ে বোল্ড করেন প্রায় ঠাসবুনটের গ্যালারিতে তখন সমুদ্রের গর্জন। সেটা ফিজের নামেই। মেক্সিকান ওয়েভ উঠতেও সময় লাগে না। দিনেশ চান্দিমাল (২৮) রান আউট। এবং ২৬তম ওভারটি লঙ্কানদের কফিনে শেষ পেরেক পুতে দেওয়ার মতো। যেখানে পর পর দুই বলে দুই শিকার সাকিবের। শেষে থাকেন আর থিসারা পেরেরা। বিপিএল সূত্রে বাংলাদেশি বোলাররা খুব পরিচিত। ধুমধাম মেরে শেষে সাকিবের বলেই ক্যাচ তুলেই ফেরা তার। এর মাঝে আছে বাংলাদেশের দারুণ ক্যাচিং, তামিমের লম্বা দৌড়ে জীবন বাজি রাখার প্রমাণ, তাৎক্ষণিকতায় রান আউট, আটো শাটো বোলিংয়ের সাথে তেমনই ঘিরে ফেলা ফিল্ডিং। যেন মাঠের ১১ জনই সাক্ষাৎ যমদূত হাথুরুর দলের জন্য!

বাংলাদেশ নেমেছিল ৪ পেসার নিয়ে। শীর্ষ ৫ ব্যাটসম্যানের কাছে ছিল অন্তত ৪৫ ওভার পর্যন্ত টেনে নেওয়ার চাওয়া। সেটা মিটিয়েছেন ব্যাটসম্যানরা। দলকে সুউচ্চ শিখর দেখিয়ে দিয়ে পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে মুশফিকুর রহীম ৫২ বলে ৬২ করে আউট হয়েছেন ৪৭তম ওভারে। তার আগে মারমুখী শুরুতে দুই জীবন পেয়েও এনামুল হক বিজয়ের ৩৫ একটা ভালো শুরু এনে দিয়েছে।

আসলে বাংলাদেশের কাজের কাজটা করে দিয়েছে আগেই টপ ব্যাটারদের পার্টনারশিপগুলো। তামিম ইকবাল ৮৪ রান করে আউট হয়েছেন। সেঞ্চুরি মিসের আক্ষেপ তার। তবে ওপেনিংয়ে বিজয়ের সাথে ৭১ রানের জুটি। তারপর বন্ধু সাকিবের সাথে ৯৯ রানের। তরতরিয়ে রানের চাকা চলে। মুশফিকের সাথে তৃতীয় উইকেটে সাকিবের অবদান ৫৭। আবার সাকিব চলে গেলে দুই আত্মীয় মুশফিক ও মাহমুদ উল্লাহর ৫০ রানের জুটি। তারপর কিছুটা ছন্দপতনের আগেই আসলে তিনটি ফিফটি জয়ের পথের আগাম নির্দেশ দিয়েছে। মাহমুদউল্লাহর ২৪ দিয়েছেন পাঁচে। সাথে জুটি। আর সাব্বির রহমান? ১২ বলে অপরাজিত ২৪ তো ঠিক ক্যাপ্টেনের চাওয়া মতোই হয়েছে। হয়নি কেবল সাতে মাশরাফির (৬) নেমে কিছু করা, নাসির তো গোল্ডেন ডাকের মালিক আটে। সাইফ উদ্দিনের অপরাজিত ৬ও কিন্তু ঠিক ৬টা রানই যোগ করে টোটালের সাথে!

এমন এক ম্যাচে আসলে পুরো তৃপ্তি ও পয়সা উশুলের সাথে প্রতিশোধের হাসি নিয়েই ঘরে ফেরেন দর্শকরা। তার আগে তাদের হাজারো হাতে জ্বলে ওঠা মোবাইলের আলো জোনাকির আলোর উৎসবের মতো একসাথে জানিয়ে দেয়, সত্যিকার অর্থেই এই আসরে টাইগাররা শিরোপা না জিতলে সেটা হবে খুব অন্যায়! একটু বেশি বলা হলো? পক্ষপাতমূলক? আরেকবার ভেবেই দেখুন না মাশরাফিদের দুই ম্যাচের জয়ের ধরন বিচার করে!

সংক্ষিপ্ত স্কোর :

বাংলাদেশ : ৫০ ওভারে ৩২০/৭ (তামিম ৮৪, বিজয় ৩৫, সাকিব ৬৭, মুশফিক ৬২, মাহমুদউল্লাহ ২৪, সাব্বির ২৪*, মাশরাফি ৬, নাসির ০, সাইফ ৬*; লাকমল ০/৬০, প্রদিপ ২/৬৬, ধনঞ্জয়া ১/৪০, থিসারা ৩/৬০, গুনারতেœ ১/৩৮, হাসারাঙ্গা ০/৫১)।

শ্রীলঙ্কা : ৩২.২ ওভারে ১৫৭/১০ (কুশল পেরেরা ১, থারাঙ্গা ২৫, মেন্ডিস ১৯, ডিকভেলা ১৬, চান্ডিমাল ২৮, গুনারতেœ ১৬, থিসারা পেরেরা ২৯, হাসারাঙ্গা ০, ধনাঞ্জয়া ১৪, লাকমল ১, প্রদিপ ০*; নাসির ১/২০, মাশরাফি ২/৩০, রুবেল ২/২০, মোস্তাফিজ ১/২০, সাকিব ৩/৪৭, সাইফ উদ্দিন ০/১৪)।

ফল : বাংলাদেশ ১৬৩ রানে জয়ী।

ম্যান অব দ্যা ম্যাচ : সাকিব আল হাসান।

আজকের বাজার: সালি / ১৯ জানুয়ারি ২০১৮