অর্থনীতির স্বার্থে গভর্নরের মেয়াদ বাড়নোর উদ্যোগ

করোনায় ক্ষতি মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন ও আর্থিক খাতের স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের মেয়াদ বাড়াতে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে এ ধরনের উদ্যোগ এটাই প্রথম। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

সরকারি নিয়মে চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে চাকরিতে বহাল থাকার মেয়াদ ৬৫ বছর। আগামী ৩ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের বয়স ৬৫ বছর পূর্ণ হবে। তার আগেই এ পদে বহাল রাখতে বয়সসীমা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

জাতীয় সংসদের অধিবেশন না থাকায় এ বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হবে। তার আগে আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং নিতে হবে। রাষ্ট্রপতির আদেশ জারির মাধ্যমে বিষয়টি চূড়ান্ত করতে ঈদের ছুটি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

তবে এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এটা যদি হয় তা হলে বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই হবে প্রথম ঘটনা। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে যেকোনো আইন সংশোধন হতেই পারে। তবে কোনো ব্যক্তিকে স্বপদে বহাল রাখার জন্য আইন সংশোধন করা ঠিক হবে বলে আমি মনে করি না। এটা একটা খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকবে।’

আইন সংশোধনের প্রসঙ্গে সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘গভর্নরের বয়স ও মেয়াদ নির্ধারণ করে দেওয়ার বিষয়ে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধনের মাধ্যমে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। তার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে দায়িত্ব পালনকারী অনেক গভর্নরের বয়স ৬৫ বছরের বেশি ছিল। কেন এটি করা হয়েছে, তা আমি জানি না। তবে বিশ্বের উল্লেখযোগ্য কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের বয়স নির্ধারণ করা নেই। তবে সরকার যদি অর্থনীতির স্বার্থে বর্তমান গভর্নরের মেয়াদ বাড়াতে চায়, তাহলে আইন সংশোধন করতেই হবে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘করোনার কারণে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত লক্ষাধিক কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। সেগুলোর বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। এর আগে ব্যাংকগুলোতে টাকার প্রবাহ বাড়াতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে, ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার যোগান, সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ড কেনার বিপরীতে আটকে থাকা অর্থ ছাড়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রয়োজনে অর্থের যোগান, বৈদেশিক উৎস থেকে ব্যাংকগুলোর অর্থ সংগ্রহের বিধি শিথিল করা, বৈদেশিক মুদ্রা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিক্রি করে নগদ অর্থ নিতে পারা। এই উদ্যোগগুলো চলমান রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে সব কিছু প্রায় স্থবির হয়ে আছে। এসব কিছুর মধ্যেও বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের আর্থিক ব্যবস্থা সচল রাখতে সচেষ্ট। দেশের অর্থনীতি আজ নানা ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছে। এমূহুর্তে একজন নতুন গভর্নর খুঁজে পাওয়া দুস্কর। আর পাওয়া গেলেও বিদ্যমান পরিস্থিতি বুঝে উঠতেও বেশ সময় লেগে যাবে। ফলে চলমান কর্মকাণ্ডের গতি হারানোর সম্ভাবনা থেকে যায়। এসব বিবেচনায় বর্তমান গভর্নরকে দিয়েই আর্থিক খাতের চলমান কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে সরকার। আর এ জন্য আইন সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করার পরের দিনই ফজলে কবিরকে চার বছরের জন্য গভর্নর নিয়োগ দেয় সরকার। তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরে ছিলেন। তিনি দেশে ফিরে ২০ মার্চ গভর্নরের দায়িত্ব নেন। সে হিসেবে তার ৪ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল এ বছরের ১৯ মার্চ। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩৪ দিন আগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গভর্নর হিসেবে ফজলে কবিরের মেয়াদ ৩ মাস ১৩ বাড়ানো হয়। এতে বলা হয়, ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি গভর্নর থাকবেন।

সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের বয়সের সীমারেখা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে একটি সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করে। অর্থমন্ত্রী গত ১৮ মে সোমবার তা অনুমোদন করেন। এর পরের দিন ১৯ মে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তা উপস্থাপন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। সেখান থেকে আইন মন্ত্রণালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির অর্ডারের জন্য পাঠানো হবে বলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

১৯৭২ সালে জারি করা রাষ্ট্রপতির ১২৭ নম্বর আদেশে গঠিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন সময়ে সংশোধিত ও পরিমার্জিত হওয়া বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারকে ২০০৩ সালের ১০ মার্চ বিধিবদ্ধ করা হয়। ওই সময় অর্ডারটির ১০ বিধির ৫ উপবিধিতে সংযুক্ত করা হয় গভর্নরের মেয়াদ ও সর্বোচ্চ বয়সসীমা।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর প্রথম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আ ন ম হামিদুল্লাহ। তিনি ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৪ সালের ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ১১তম গভর্নর হিসেবে ফজলে কবির ২০১৬ সালের ১৬ মার্চে যোগ দিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন গভর্নর ছিলেন এম নুরুল ইসলাম। ১৯৭৬ সালের ১৩ জুলাই থেকে ১৯৮৭ সালের ১২ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ১১ বছর গভর্নর ছিলেন তিনি। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রায় সাত বছর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ড. আতিউর রহমান। তবে এ পর্যন্ত কোনো গভর্নরকে স্বপদে নিয়োজিত রাখতে আইনের সংশোধন করতে হয়নি। এবারই প্রথম ফজলে কবিরকে স্বপদে নিয়োজিত রাখতে আইনের সংশোধন আনা হচ্ছে।