চামড়া নিয়ে বিপাকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা

কোরবানির পশুর চামড়া কিনে বিপাকে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। ঈদের দিন ঘুরে কোরবানির কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা মৌসুমি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। অভিযোগের তীর ছুড়ছেন ট্যানারি মালিকদের দিকে। এ সকল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্যানারি মালিকরা কমমূল্যে চামড়া কেনার উদ্দেশ্যে একটি চক্রকে মাঠে নামিয়েছেন। ফলে অনেকেই নিজের কোরবানির পশুর চামড়া অল্পমূল্যেই বিক্রি করে দিয়েছেন ব্যবসায়ীদের কাছে।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, একটি সিন্ডিকেট ছলচাতুরিতে কমমূল্যে চামড়া কেনার চক্রান্ত করছে। গত বছর এক কোটি পিস চামড়া কিনলেও এ বছর ট্যানারি ব্যবসায়ীরা সোয়া কোটি পিস পশুর চামড়া কিনবে বলে নির্ধারণ করেন। কিন্তু তারা উল্টো বলছেন, গত বছরের চামড়ার ৫০ শতাংশ রয়ে গেছে। নতুন করে চামড়া কেনার আগ্রহ নেই। ফলে দাম কমছে। পুরান ঢাকার কাঁচা চামড়ার আড়তদার ও ব্যবসায়ীদের বলছেন, বিক্রেতারা চামড়ায় লবণ লাগিয়ে দিতে হবে। এছাড়া মূল্যের সম্পূর্ণ টাকাও তারা নগদে দেবেন না। কেনার সময় অর্ধেক এবং বাকি টাকা সুবিধাজনক সময়ে পরিশোধ করতে চান তারা। এদিকে সময়মতো চামড়া বিক্রি করতে না পারলে তাতে পচন ধরবে। এত শর্ত মেনে চামড়া বিক্রির পর লোকসানের পরিমাণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় সময় পার করছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

চামড়া সংশ্লিষ্টরা বলেন, কারণে-অকারণে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের দোষ দেওয়া হয়। কিন্তু কেউ পৃষ্ঠপোষকতা করেন না। কোরবানির ঈদে যদি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া না কেনেন, তাহলে ট্যানারি মালিক, আড়তদাররা এত চামড়া সংগ্রহ করবেন কিভাবে?

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গরুর চামড়া সরকার নির্ধারিত দামে প্রতি বর্গফুট ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হলেও ছাগলের চামড়া ফুট হিসেবে বিক্রি না করে আকার ভেদে ৩০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মৌসুমি বিক্রেতা মোবারক আলী বলেন, হাজারীবাগের ট্যানারি মালিকরা এবার চামড়া কিনতে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। সরকার ছাগলের চামড়ার জন্য প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা দাম নির্ধারণ করে দেয়ায় প্রতিটি চামড়া ১০০ থেকে ১২০ টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা পুরো চামড়া ৩০-৫০ টাকার বেশি দিতে চান না। তবে আবহাওয়া ভালো থাকায় গতবারের তুলনায় এবার দেশে কোরবানির পশুর চামড়ার মান ভালো বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, হাজারীবাগে ১৫৫টি ট্যানারি ছিল। সেগুলোর মধ্যে ৬৭টি সাভারে চালু হয়েছে।

যদিও সিন্ডিকেট করে চামড়ার মূল্য কমানোর অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন মাহিন বলেন, হাজারীবাগ থেকে আমাদের চামড়া কারখানাগুলো গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। এখনও সাভারের স্থানান্তরিত কারখানাগুলোর নির্মাণ কাজ শতভাগ শেষ হয়নি। ফলে কোরবানির পশুর সব চামড়া সেখানে নিয়ে প্রক্রিয়াজাত করার মতো জায়গা ও ব্যবস্থা আমাদের নেই। এ কারণে আমরা এবার চামড়া কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছি না।

বাংলাদেশ লেদার অ্যান্ড লেদার গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক আরিফ বলেন, হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো সাভারে স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় থাকায় এবার চামড়া কেনার চাহিদা কমে গেছে। ছোট ট্যানারিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছাগল বা ভেড়ার চামড়া ও গরুর মাথার চামড়া প্রক্রিয়া করার ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে হাজারীবাগে। ফলে এবার এ চামড়ার চাহিদা নেই। আরিফ বলেন, হাজারীবাগে ছোট বড় প্রায় চারশ ট্যানারি ছিল। সেগুলো বন্ধ হয়ে সাভারে চালু হয়েছে মাত্র অর্ধশতাধিক ট্যানারি। এর মধ্যে মাত্র ৪-৫টি ট্যানারি আছে, যারা গরুর মাথার চামড়া ও ছাগলের চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে পারে। হাজারীবাগের ছোট ট্যানারিগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে গেছে। গত বছর আমি নিজে দুই হাজার পিস চামড়া কিনেছিলাম। এবার কিনেছি মাত্র ১০০০ পিস। পাশাপাশি চামড়ার দামও কম। আরেক ব্যবসায়ী আবদুল মালেক জানান, গত বছর তিনি ১৮ থেকে ২০ হাজার চামড়া কিনেছিলেন। এবার কিনেছেন মাত্র ৫ হাজার। হাজারীবাগের কারখানা বন্ধ করে দেয়ায় ব্যবসার এই মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানান মালেক। আমরা সাভারে প্লট পাইনি। হাজারীবাগের সব মেশিনপত্র বন্ধ হয়ে আছে। তাই কাঁচা চামড়া কেনার দিকে বেশি গুরুত্ব দিইনি। ব্যবসা ধরে রাখার জন্য কিছু চামড়া কিনেছি।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এম সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, গত বছর লক্ষ্যের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি চামড়া সংগ্রহ হয়েছিল। এবার লক্ষ্য পূরণ না হলেও কাছাকাছি পৌঁছাবে বলে তারা মনে করছেন। এবার গরুর ৫০ লাখ, মহিষের ৫ লাখসহ ছাগল-ভেড়া মিলিয়ে ৮০ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ হবে বলে আশা করছেন সাখাওয়াত উল্লাহ।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪.৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১.৮২ শতাংশ ছাগলের, ২.২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১.২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। এর অর্ধেকের বেশি আসে কোরবানির ঈদের সময়।

আজকের বাজার: আরআর/ ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭