নায়করাজ দ্য লিজেন্ড. জন্মদিনের শুভেচ্ছা

তিনি বাংলার নায়করাজ। সেলুলয়েডের ফিতায় তার অসংখ্য চরিত্র অমর হয়ে আছে দর্শকের হৃদয়ে। যার মধ্যে ছুটির ঘণ্টার স্কুল দপ্তরী, জীবন থেকে নেয়ার বিপ্লবী যুবক অন্যতম। বলছি ঢাকাই ছবির অহংকার রাজ্জাকের কথা। জীবনের মানচিত্রে বহুপথ পাড়ি দিয়ে গেল বছরের ২১ আগস্ট পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন তিনি।

২৩ জানুয়ারি ছিল চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তির জন্মদিন। বেঁচে থাকলে ৭৭ বছরে পা রাখতেন তিনি। নায়করাজের জন্মদিনকে ঘিরে চলচ্চিত্রাঙ্গনসহ শোবিজের নানা অঙ্গনে ছিল বর্ণিল সব আয়োজন। ব্যক্তিগতভাবে তো বটেই নানা সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও ভালোবাসায় সিক্ত করেন প্রিয় নায়ককে স্বরণ করে। কিংবদন্তি এই অভিনেতার পৃথিবীতে আগমনের দিনটি উদযাপন করছেন তার পরিবার, চলচ্চিত্র শিল্পী-কুশলী ও ভক্তরা। দেশের রেডিও টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলো প্রচার করে নানা আয়োজন।

এ উপলক্ষে ঐদিন সকালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির পক্ষ থেকে বনানী কবরস্থানে নায়করাজের কবরে পুúস্তবক অর্পণ করা হয়। উপস্থিত ছিলেন সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর, সহ-সভাপতি রিয়াজ ও সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান। তারা শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে দোয়ায় অংশ নেন।
এ সময় মিশা সওদাগর বলেন, ‘অনেক পূর্ণতা ঢেকে যায় রাজ্জাক ভাইয়ের না থাকার শূন্যতায়। মহান আল্লাহ্ তাকে বেহেশত দান করুন এই প্রার্থনা করছি।’

জন্মদিন উপলক্ষে তার কালজয়ী কিছু চলচ্চিত্র উপভোগ করা যাচ্ছে মোবাইল ফোন কোম্পানির ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোতে। ‘দ্য লেজেন্ড নায়করাজ রাজ্জাক স্পেশাল’ বিভাগে রয়েছে এসব ছবি। রাজ্জাক অভিনীত নতুন পুরনো ছবির তালিকায় রয়েছে ‘বেহুলা’, ‘রংবাজ’, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘অমর প্রেম’, ‘ঢাকা ৮৬’, ‘সৎ ভাই’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘বেঈমান’, ‘কখগঘ’, ‘চাচ্চু আমার চাচ্চু’, ‘আকাশ কতো দূরে’।

১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন রাজ্জাক। জন্ম কলকাতার টালিগঞ্জে হলেও দেশভাগের সময় তিনি পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় পাড়ি জমান। নায়ক হিসেবে চলচ্চিত্রে নায়করাজের যাত্রা শুরু হয় জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে। এতে তার বিপরীতে ছিলেন কোহিনূর আক্তার সুচন্দা।

প্রযোজক হিসেবে নায়করাজের যাত্রা শুরু ‘রংবাজ’ ছবিটি প্রযোজনার মধ্য দিয়ে। এটি পরিচালনা করেছিলেন জহিরুল হক। রাজ্জাকের বিপরীতে ছিলেন কবরী। ববিতার সঙ্গে জুটি বেঁধে নায়করাজ প্রথম নির্দেশনায় আসেন ‘অনন্ত প্রেম’ চলচ্চিত্র দিয়ে। এই ছবিটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। নায়ক হিসেবে এ অভিনেতার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ছিল শফিকুর রহমান পরিচালিত ‘মালামতি’। এতে তার বিপরীতে ছিলেন নূতন।

নায়করাজ রাজ্জাক সর্বশেষ তার বড় ছেলে নায়ক বাপ্পারাজের নির্দেশনায় ‘কার্তুজ’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এই চলচ্চিত্রে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রয়াত পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামও অভিনয় করেছিলেন। চাষী নজরুল ইসলামের প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমাতেও রাজ্জাক অভিনয় করেছিলেন।

অন্যদিকে নায়করাজ সর্বশেষ ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত ‘আয়না কাহিনী’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন। এই চলচ্চিত্রে জুটি হিসেবে অভিনয় করেছিলেন সম্রাট ও কেয়া। এরপর আর নতুন কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণে তাকে দেখা যায়নি।

এক নজরে নায়করাজ:
কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় সরস্বতী পূজা চলাকালীন মঞ্চনাটকে অভিনয়ের জন্য তার গেম টিচার রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাকে বেছে নেন নায়ক অর্থাৎ কেন্দ্রীয় চরিত্রে। শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক বিদ্রোহীতে গ্রামীণ কিশোর চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই নায়করাজের অভিনয়ে সম্পৃক্ততা।

তিনি ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমান। প্রথমদিকে রাজ্জাক তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হন। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে তিনি আব্দুল জব্বার খানের সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। সালাউদ্দিন প্রোডাকশন্সের তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগড় লেন চলচ্চিত্রে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করে সবার কাছে নিজ মেধার পরিচয় দেন রাজ্জাক।

পরবর্তীতে কার বউ, ডাক বাবু, আখেরী স্টেশনসহ আরও বেশকিছু ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয়ও করেন। পরে বেহুলা চলচ্চিত্রে তিনি নায়ক হিসেবে ঢালিউডে উপস্থিত হন সদর্পে। তিনি প্রায় ৩০০টি বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। পরিচালনা করেছেন প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্র।

রাজ্জাক প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন ‘কি যে করি’ ছবিতে অভিনয় করে। পাঁচবার তিনি জাতীয় সম্মাননা পান। ২০১৩ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তিনি আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কার পেয়েছেন অসংখ্যবার।

স্ত্রী খাইরুন্নেছাকে ভালোবেসে লক্ষ্মী বলে ডাকতেন। তার তিন পুত্র ও দুই কন্যা। তারা হলেন বাপ্পারাজ (রেজাউল করিম), নাসরিন পাশা শম্পা, রওশন হোসেন বাপ্পি, আফরিন আলম ময়না, খালিদ হোসেইন সম্রাট। দুই পুত্র বাপ্পারাজ ও সম্রাট চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত।

পুরো নাম : আবদুর রাজ্জাক।
বাবা : আকবর হোসেন।
মাতা : নেসারুন্নেসা।
অভিনয়ের গুরু: পীযুষ বোস।
অভিনয়ে পারিবারিক সমর্থন : মেজ ভাই আবদুল গফুর।
চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততা : আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে উজালা চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক হিসেবে।
নায়ক হিসেবে প্রথম চলচ্চিত্র : জহির রায়হানের ‘বেহুলা’।
প্রথম নায়িকা : কোহিনূর আক্তার সুচন্দা।
জুটি হিসেবে জনপ্রিয়তা : কবরীর সঙ্গে। প্রথম চলচ্চিত্র সুভাষ দত্তের ‘আবির্ভাব’।
নায়ক হিসেবে অভিনয় : ১৯৯০ সাল পর্যন্ত।
চরিত্রাভিনেতা হিসেবে অভিনয় : ১৯৯৫ সাল থেকে।
প্রথম প্রযোজিত চলচ্চিত্র : রংবাজ (রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন্স), পরিচালক জহিরুল হক। বিপরীতে কবরী।
প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র : ‘অনন্ত প্রেম’ (১৯৭৭), বিপরীতে ববিতা।
সর্বশেষ পরিচালিত চলচ্চিত্র : ‘আয়না কাহিনী’ (২০১৪)।
সর্বশেষ অভিনীত চলচ্চিত্র (এখন পর্যন্ত) : বাপ্পারাজ পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘কার্তুজ’।
নায়ক হিসেবে যাদের বিপরীতে কাজ করেছেন : সুচন্দা, কবরী, শবনম, শাবানা, নাসিমা খান, সুজাতা, ববিতা, কবিতা, নূতন, অঞ্জনা, কাজরীসহ আরও অনেকে।
জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি : বাংলাদেশের মানুষের অপরিসীম ভালোবাসা ও বন্ধু সাংবাদিক প্রয়াত আহমদ জামান চৌধুরীর লেখনীর মধ্যদিয়ে নায়করাজ উপাধি অর্জন।

আজকের বাজার: সালি / ৩১ জানুয়ারি ২০১৮