অর্থনীতি যে গতিতে এগোচ্ছে আর্থিক খাতকেও সে গতিতে এগোতে হবে

অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর ভর করেই এগিয়ে যায় একটি দেশ। আমাদের দেশের আর্থিক খাত, কমার্শিয়াল ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা এখন বেশ উন্নত। শীর্ষস্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান সিভিসিএফএলের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন মাহমুদ হোসেন। অর্থনীতির এই বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার ওপরে দৈনিক আজকের বাজার ও এবি টিভির সাথে আলোচনা করেছেন। আলোচনার অনুলিখন দৈনিক আজকের বাজারের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।

সার্বিকভাবে আমাদের দেশের অবস্থা এখন খুব ভালো। আর্থিক খাত, কমার্শিয়াল ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এখন বেশ উন্নত হয়েছে। কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে বিবেচনা করতে গেলে দেখা যাবে কোনোটা একটু ভালো আবার কোনোটার অবস্থা তত বেশি ভালো না। যেমন সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুব একটা ভালো না। আবার যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্টক মার্কেটের সাথে ইনভলভ ছিল, তারা ২০০৯ সালের ধাক্কাটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এ ছাড়া দু-একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা মিস ম্যানেজমেন্ট বা বিভিন্ন কারণে বিপদে পড়েছে। সব মিলিয়ে স্বাভাবিকভাবে বলতে গেলে অবস্থা ভালোই আছে। সমস্ত লিস্টেড আর্থিক প্রতিষ্ঠানই এ ক্যাটাগরির। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে থাকতে হলে মিনিমাম ১০ পার্সেন্ট ডিভিডেন্ট দিতে হচ্ছে। ১০ পার্সেন্ট ডিভিডেন্ট দিতে হলে তার মিনিমাম ১২ পার্সেন্ট আয় করতে হচ্ছে।

ব্যবসায় ঝুঁকি
সব ব্যবসাই চ্যালেঞ্জফুল ও কমপিটিশনের মধ্যে থাকে। যেমন ২০০০ সালের পর ২০১৫ সালে এসে মাত্র দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। গত ১৫ বছরে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হলো। ব্যাংক সেক্টরেও দেখা যাচ্ছে যে গত ১৫ বছরে ৮টি বা ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আমরা যদি ২০০০ বা ২০০১ সালকে ইনডিকেটর হিসেবে ধরি, তাহলে দেখা যাবে যে তখন বাংলাদেশের ইকোনমি ছিল ৪৫ থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলার। এখনকার ইকোনমি অলমোস্ট থ্রি টাইমস বিগার। কিন্তু ব্যাংকের সংখ্যা সেভাবে বাড়েনি। একই ব্যাংক রেখে তার ব্রাঞ্চের সংখ্যা বাড়াতে পারে। অথবা অন্য কোনো টেকনোলজির সহায়তা নিয়ে তাদের এক্সেস বাড়াতে পারে। এটি না থাকার কারণে অসম প্রতিযোগিতা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর ডিপোজিটও বেড়েছে। এখন দেখতে হবে বিজনেস ওয়েগুলো ঠিক আছে কি না বা ঠিকমতো রিটার্ন হচ্ছে কি না।

প্রতিটি বিজনেসেই কিছু ভ্যালুয়েশন অ্যান্ড কিছু সাকসেস থাকবে। নতুন কোনো ব্যাংক দেওয়া হচ্ছে না; আমি এর পক্ষপাতি না। তাহলে কি ১৫ বছর পর আর কোনো নতুন উদ্যোক্তা থাকবে না? যারা নতুন আইডিয়া নিয়ে আসতে পারে, তারাও তো আসতে পারে। তাহলে তাদের সুযোগটা কী? আজ থেকে ১০ বছর পরে বা ১৫ বছর পরে যারা আসবে, তারা তো আরও ভালো আইডিয়া নিয়ে আসবে। এখন যদি বলা হয়, না এই ব্যাংকগুলোই থাকবে; তাহলে তো নতুন জেনারেশনকে সংযুক্ত করা হলো না।

প্রয়োজনে দেখে-শুনে, যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেওয়া হোক। কীসের ভিত্তিতে নতুন ইনস্টিটিউটকে লাইসেন্স দেওয়া হবে, সেটা জেনে-বুঝে উদ্যোগ নেওয়া হোক। তবে নতুনদের তো বঞ্চিত করা যাবে না। যেহেতু আমাদের ইকোনমিক অবস্থা লো লেভেল থেকে উত্তরণের দিকে যাচ্ছে। আমাদের ইকোনমি সাইজটা কিন্তু বাড়ছে। ইকোনমি সাইজটা যে রেশিওতে বাড়বে, ফিন্যান্সিয়াল সেক্টরটা তার চেয়ে বেশি রেশিওতে বাড়তে হবে। সুতরাং ফিন্যান্সিয়াল সেক্টরে এক্সপ্রেশনটা আরও বেশি হবে।

অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট
যখন কোনো কোম্পানিকে লোন না দিয়ে ইক্যুইটি দেওয়া হয়, অর্থাৎ শেয়ারহোল্ডার বানিয়ে নেওয়াকে অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট বলা হয়, এটাকে পার্টনারশিপ ইনভেস্টমেন্টও বলা যায়। ইটস লাইক অ্যা শেয়ারহোল্ডার। আবার এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে কেউ যদি শেয়ার কেনে, ওটাকেও শেয়ারহোল্ডার বলে। যদিও আমাদের দেশে বলতে শোনা যায়, ইনভেস্টর আর শেয়ারহোল্ডার আলাদা। আসলে ইনভেস্টর বলতে কিছু নেই। ইভেন প্রথমে যারা ইনভেস্ট করেছে, তারাও শেয়ারহোল্ডার।

ইক্যুইটি শেয়ারহোল্ডার শুধু প্যাসিভ না, অ্যাকটিভও হতে পারে। অনেক সময় মেজরিটি শেয়ারহোল্ডারও হতে পারে। দেখা গেল একটি কোম্পানির ভালো সম্ভাবনা আছে, কিন্তু কোনো কারণে এখন ভালো করছে না বা করতে পারছে না। তখন যাদের ফান্ড আছে তারা গিয়ে ইক্যুইটি শেয়ারহোল্ডার হলো। এরপর কোম্পানিটিকে ভালোভাবে নার্সিং করে আবার মার্কেটে ফিরিয়ে আনল। এটাই প্রাইভেট ইক্যুইটি। অথবা এমনও দেখা যায়, একটা কোম্পানি শুরু করেছে। ভালোভাবে গ্রো করার সম্ভাবনা আছে; তখন গিয়ে কেউ ওটার শেয়ারহোল্ডার হলো। সেটা মাইনরিটি বা মেজরিটিও হতে পারে।

এরপর ভালোভাবে গ্রোথ করার পর একটা ভালো প্রফিট নিয়ে বের হয়ে এল। এতে বলা যায়, অ্যাকচ্যুয়াল ক্যাপিটাল মার্কেট প্রাইভেট ইক্যুইটির মাধ্যমে হচ্ছে। কিন্তু সেকেন্ডারি মার্কেটে কেনা-বেচাতে অ্যাকচ্যুয়ালি কোম্পানির কোনো লাভ হয় না। অথচ প্রাইভেট ইক্যুইটিতে কোম্পানিটিকে সরাসরি ইনভেস্ট করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোম্পানিকে নার্সিং করতে হেল্প করা হয়। এর জন্য দরকার লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক, যেটি এখনো বাংলাদেশে নেই। যদিও অলরেডি একটি এসএসসি রুল করা হয়েছে। দ্যাটস আ গুড স্টেপ।

ইক্যুইটি শেয়ারহোল্ডারে কন্ট্রাক্ট ল জরুরি
ইক্যুইটি শেয়ারহোল্ডারের জন্য কন্ট্রাক্ট ল অতি জরুরি। কত পার্সেন্ট স্টেক নেওয়া হচ্ছে, কোন কোন বিষয়ে পারফর্ম করতে হবে, কোম্পানির উন্নয়নের জন্য কার কী করণীয় এসব বিষয়ে স্পষ্ট কন্ট্রাক্ট সাইন থাকতে হবে। কন্ট্রাক্ট সাইন না থাকলে যে কাজগুলো করার ছিল, সেগুলো না করলে রিমেডি থাকবে না; যে কারণে কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এটি হয়নি।

নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ
আমরা ইতোমধ্যে এফআইআর প্রতিষ্ঠা করেছি। এখন অল্টারনেটিভ ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি করতে যাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে রেগুলেটরি পয়েন্ট অব ভিউ থেকে কোনো রকম বাধা পাইনি। বরং সাপোর্ট পেয়েছি। বলতেই হয়, বাংলাদেশে এখনো যদি কেউ ভালো আইডিয়া নিয়ে প্রফেশনালি অ্যাপ্রোচ করে, তবে সাপোর্ট পাওয়া সম্ভব।

যা হোক, বাংলাদেশে কিন্তু এটা নতুন ধরন নিয়েছে। ম্যানপাওয়ার বিষয়ে আইডিয়া ও কনসেপ্ট বোঝাটায় কিছু সমস্যা হতে পারে। সুতরাং বলা যায়, চ্যালেঞ্জ রয়েছে সামনে। হিউম্যান রিসোর্স কোথা থেকে পাওয়া যাবে বা যেসব কোম্পানির কাছে যাব তারা বিষয়টি কীভাবে নেবেÑ এসব সমস্যা হতে পারে। তবে সমস্যার কথা না ভেবে শুরু করতে হবে। অলরেডি দু-একটা কোম্পানি লাইসেন্স নিয়েছে। শুরু করলেই ধীরে ধীরে বোঝা যাবে আমাদের কোথায় কোথায় সমস্যা আছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট কিন্তু লোনের ওপর ডিপেন্ডেন্ট। যারা এখানে এফিসিয়েন্সি নিয়ে আসবে, যারা ইনভেস্ট করবে, তারা নিশ্চিত করতে চাইবে কীভাবে কোম্পানিটা রান করবে। তবেই তো লাভটা আসবে।  আমাদের দেশে বলা হয় আমরা উদ্যোক্তা বানাতে চাই, চাকরিজীবীর চেয়ে উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়াতে চাই। অথচ উদ্যোক্তাদের জন্য স্পেসিফিক ইনসেনটিভ নেই। কেউ নিজ উদ্যোগে ব্যবসা শুরু করলে প্রথম দিন থেকেই তো লাভ হবে না; অথচ সরকারকে ঠিকই ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে। লাভ হোক আর লোকসান হোক, ভ্যাট থেকে মুক্তি নেই।

একজন নতুন উদ্যোক্তাকে অফিস ভাড়া নেওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি জায়গায় ভ্যাট দিতে হচ্ছে। দেখা যায়, ওখান থেকেই লোকসানের দিকে যেতে শুরু করে তারা। আমরা যদি সত্যি উদ্যোক্তা বাড়াতে চাই, তাহলে নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু ছাড় দিতে হবে। এমনও হতে পারে, নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য প্রথম তিন বছর ভ্যাট মওকুফ। তাহলে বোঝা যেত, আমরা নতুনদের উৎসাহ দিচ্ছি। ইভেন ট্যাক্সের ক্ষেত্রে তাদের জন্য কিছু ইনসেনটিভ থাকতে পারত। এ ছাড়া যারা বিলো থার্টি ইয়ার্স আছে, তাদের জন্যও কিছু ইনসেনটিভ থাকা জরুরি। নতুনদের যদি শুরুতেই এই পিরিয়ডটায় একটু সাপোর্ট দেওয়া যায়, তাহলে বিজনেসগুলো বেশির ভাগই দাঁড়িয়ে যেত। পরে তারাই ট্যাক্স হিসেবে বেশি কন্ট্রিবিউট করতে পারবে। তাদের ওপর এভাবে চাপিয়ে না দিলে পরে আরও বেশি ট্যাক্স পাওয়া যেত।

বিদেশি অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট
বাইরের ফার্মগুলোর মধ্যে দুই ধরনের ফার্ম এসেছে। একটা সোশ্যাল লেভেলে আছে আর বাকিগুলোর মধ্যে আইএফসি ও ব্রামারস আছে। এগুলোর কোনোটিই দেশি ফার্ম না। এগুলো এক্সট্রা ফাংশন। বাইরের ফান্ড থেকে সে যখন ইনভেস্ট করছে, তখন হবে নরমাল ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট। আমাদের নতুন রুল অনুযায়ী এটা প্রাইভেট ইক্যুইটি ইনভেস্টমেন্টের মধ্যে পড়ে না। কারণ ওটা বাইরে রেজিস্ট্রি করা। বাংলাদেশে অনেক সম্পদশালী মানুষ আছেন, যাঁরা ইনভেস্ট করে রাখতে পারেন। এখানে প্রতি তিন মাস বা ছয় মাস পর বেনিফিট পাবেন এমন না। বেনিফিট পেতে হলে পাঁচ বছর বা ছয় বছর অপেক্ষা করতে হবে। তারপর একটা ভালো প্রফিট পাওয়া যাবে।

এভাবে যদি কেউ পাঁচটি কোম্পানিতে শেয়ার করেন, তাহলে দুইটা ভালো করতে না পারলেও বাকি তিনটা ঠিকই ভালো করবে। এভাবে সব মিলিয়ে ভালো কিছু হবে। স্টক মার্কেটে দেখা যায় একজনেরটা আরেকজন সেল করছেন, কিন্তু আসল কোম্পানিতে টাকা যাচ্ছে না। আদার দ্যান আইপিও। আমাদের এই সিস্টেমে কিন্তু সরাসরি কোম্পানিতে যাচ্ছে। সুতরাং এখানে ফাইন্যান্স সেক্টর আর রিয়েল সেক্টরের সাথে সরাসরি যোগাযোগ আছে। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে ধীরে ধীরে প্রাইভেট ইক্যুইটি সেক্টর গড়ে উঠবে। দক্ষতা বাড়বে।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের করণীয়
আমাদের দেশে পুঁজিবাজার আরও ভালো হবে যদি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ে। ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টরদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। আমাদের দেশে ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টরদের বিষয়ে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে তাঁদের দায়িত্ব হচ্ছে মার্কেট বাঁচানো। কিন্তু না, ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টরদের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে তার বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। বাজার বাঁচানোর দায়িত্ব তাদের না। বাজার তার নিজস্ব গতিতেই চলবে। আর ইনভেস্টরের স্বার্থ দেখলে যেটা হবে তা হলো, মার্কেট যখন দাঁড়াবে তখন তারা অটোমেটিক কিনবে। বাজার বাঁচানোর কিছু নেই।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টরদের যদি অন্য ইনভেস্টরদের আকৃষ্ট করতে হয়, তাহলে রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ট্যুলস দরকার, যেটা আমাদের নেই। সো রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ট্যুলস সংযুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে তাদের আচরণ শেয়ারহোল্ডারদের মতো করতে হবে। অর্থাৎ, তিনি শুধু শেয়ারহোল্ডার কেনাবেচার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবেন না। লক্ষ্য রাখতে হবে, তিনি নিয়মিত এজিএমে যাচ্ছেন কি না বা কোম্পানির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন কি না। এসব কালচার কিন্তু বাংলাদেশে এখনো আসেনি।

মাহমুদ হোসেন
চেয়ারম্যান, সিভিসিএফএল