আলমগীর কবির, বিহাইন্ড দ্যা সিন

‘দিস ইজ রেডিও বাংলাদেশ মুজিবনগর’ রেডিও থেকে খাঁটি ব্রিটিশ উচ্চারণে ভেসে আসা এক ভরাট কণ্ঠস্বর, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের খবর বহির্বিশ্বে পৌঁছানোর এক বড় উৎস। কণ্ঠস্বরটি সব্যসাচী চিত্র পরিচালক আলমগীর কবিরের। যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি বিভাগের প্রধান এবং প্রবাসী সরকারের প্রধান প্রতিবেদক। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ও পথপ্রদর্শক ছিলেন তিনি।

১৯৩৮ সালে রাঙামাটি জেলায় আলমগীর কবিরের জন্ম, তার ডাক নাম ছিল মিন্টু। পিতার চাকরি সূত্রে ভারতের হুগলিতে থাকায় পড়াশোনা শুরু হয় হুগলি কলেজিয়েট স্কুলে। ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর ঢাকায় ফিরে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ‘৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েটের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক পাস করেন। এরপর ইংল্যান্ডে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করেন। অক্সফোর্ডে পড়ার সময় তিনি সুইডিশ পরিচালক ইংমার বার্গম্যানের ‘সেভেনথ সিল’ বেশ ক’বার দেখেন। সেটি দেখে চলচ্চিত্র তৈরির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অক্সফোর্ডেই চলচ্চিত্রের ইতিহাস, পরিচালনা করা, চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে বেশ কিছু কোর্স করেন।
৬৬ সালে দেশে ফিরে আসলে বামপন্থী আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেফতার করে, যদিও ব্রিটিশ নাগরিকত্ব থাকায় তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তারা। ছাড়া পেয়ে তিনি পুরোপুরিভাবে নিয়োজিত হন সাংবাদিকতায়। প্রথমে ‘পাকিস্তান অবজার্ভার’, এরপর ‘হলিডে’তে। এরপর নিজেই ‘দ্য এক্সপ্রেস’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন । r


জহির রায়হানের খুবই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হওয়ায় জহির রায়হানের সাথেই বিভিন্ন রণাঙ্গনে যাওয়া হয়েছে তার। যুদ্ধ চলাকালীন জহির রায়হান ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রামাণ্যচিত্রটি বানানো শুরু করেছিলেন, যেখানে মূল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছিল। এটির সহকারী পরিচালক ছিলেন আলমগীর কবির, এই প্রামাণ্যচিত্রে ধারাভাষ্যের কণ্ঠ তার দেওয়া। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটির কাজ যখন চলছে, তখন ছবির শ্যুটিং চলাকালে জহির রায়হানের কাজকর্মের ভিডিও ধারণ করেন তিনি। এভাবে জহির রায়হানের উপর একটি প্রামাণ্যচিত্র বানান। মূলত এটিই তার চলচ্ছিত্রে প্রথম কাজ।
১৯৭৩ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ধীরে বহে মেঘনা’ তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি। এখনো পর্যন্ত দেশে নির্মিত অন্য সব মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছবির থেকে এটি আলাদা। এই ছবিতে আলমগীর কবির যোগ করেছেন মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের দৃশ্য, যোদ্ধাদের যুদ্ধে যাওয়ার দৃশ্য, ১৬ই ডিসেম্বরে ট্রাকে উল্লাসরত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরে ফেরার দৃশ্যসহ মুক্তিযুদ্ধের আসল ফুটেজ।

১৯৭৫ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘সূর্যকন্যা’, এই ছবিতে সমাজ ও ইতিহাসে নারীর অবস্থান তুলে ধরেন তিনি এবং সেটি অত্যন্ত সাহসীভাবে। ছবির কাহিনী, চরিত্র, গান, সংলাপ সবই ছিল চমৎকার ও ব্যতিক্রমী। কাহিনীটি ছিল এক কল্পনাপ্রবণ শিল্পী ভাস্করকে নিয়ে, (বুলবুল আহমেদ) যে নিজের তৈরি এক নারীমূর্তির প্রেমে পড়ে, এভাবে বাস্তবতা আর কল্পনার মিশ্রনে কাহিনী এগিয়ে যায়। এ ছবিতে এক দৃশ্যে আলমগীর কবির অ্যানিমেশনের সাহায্যে কিছু প্রতীকি দৃশ্য দেখিয়েছেন, যা ঐ সময়ে সম্পূর্ণ এক নতুন ব্যাপার ছিল। ছবিটির দুটি গান ‘আমি যে আঁধারে বন্দিনী’ আর ‘চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

’৭৭ সালে তিনি বানিয়েছিলেন ‘সীমানা পেরিয়ে’। ’৭০ এর ঘূর্ণিঝড়ের এক সত্য ঘটনা নিয়ে বানানো ছবি এটি। ১৯৭০ সালের জলোচ্ছ্বাসের তিনমাস পর একজোড়া মানব-মানবীকে বরিশালের এক সামুদ্রিক চরে পাওয়া গিয়েছিলো, তারা কোনোমতে মানবেতর অবস্থায় বেঁচে ছিলো। সেসময়ে সংবাদপত্রে দেখা ঘটনা নিয়ে আলমগীর কবির বানান তার দ্বিতীয় ছবি। এরপর একে একে বানিয়েছেন মোট সাতটি ছবি, যার মধ্যে আছে ‘রূপালী সৈকতে’, ‘মোহনা’, ‘পরিণীতা’ এবং ‘মহানায়ক’। প্রত্যেকটি ছবি সমালোচক আর সচেতন দর্শকদের কাছে কাব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়।

প্রত্যেকটি ছবিতেই তিনি পেয়েছেন দেশি-বিদেশি পুরস্কার, যার মধ্যে আছে একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তার ‘মোহনা’ ছবিটি পায় ‘ডিপ্লোমা অফ মেরিট’ সম্মাননা। এছাড়াও তার চলচ্চিত্র জীবনে ি বানিয়েছেন মোট ৯টি প্রামাণ্যচিত্র।

আলমগীর কবির মূলত একটি চলচ্চিত্র আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়ে দিয়ে গেছেন, যার ধারা পরে অব্যাহত রেখেছেন তার ছাত্ররা, তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদ, মোরশেদুল ইসলাম প্রমুখ। এরা সবাই আলমগীর কবিরের গড়া ‘ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট’ ও ‘বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ’ এর ‘ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন’ কোর্সের ছাত্র ছিলেন। সবার মাঝেই তাই তিনি পরিচিত ‘চলচ্চিত্রাচার্য’ হিসেবে।

চলচ্চিত্র সমালোচনা লিখতেন তিনি নিয়মিত, বইও লিখেছেন বেশ কয়েকটি। ‘সিনেমা ইন পাকিস্তান (১৯৬৯)’, ‘ফিল্ম ইন বাংলাদেশ (১৯৭৯)’, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তার লেখা প্রবন্ধগুলো নিয়ে একটি সংকলন ইত্যাদি। তার সব লেখাই ছিল ইংরেজিতে, ফলে এসব লেখা সবসময়ই সাধারণের চোখের আড়ালেই রয়ে গেছে। তবে আশার কথা, সম্প্রতি কিছু উৎসাহী তরুণ ও গবেষক হারিয়ে যাওয়া এসব লেখা বাংলায় অনুবাদ ও সংকলন করার উদ্যোগ নিয়েছেন।

ঠিক যে সময়ে তাকে বেশি দরকার ছিল চলচ্চিত্রের নবজাগরণের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য, ঠিক সেসময়েই তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। ১৯৮৯ সালে বগুড়ায় একটা চলচ্চিত্র বিষয়ক অনুষ্ঠান শেষে ফেরার সময় নগরবাড়ি ফেরিঘাটে এক ট্রাকের ধাক্কায় গাড়িসহ নদীতে পড়ে মারা যান এই কৃতি পরিচালক। কাকতালীয় ব্যাপার হলো, তার প্রিয় ছাত্র চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদও সড়ক দুর্ঘটনাতেই প্রাণ হারান।

আজকের বাজার: সালি / ০১ জানুয়ারি ২০১৮