ডিএসইর শেয়ারে ক্রেতা মিলছে না!

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) শেয়ার বিক্রিতে ক্রেতাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। খোদ ডিএসইর পরিচালনা পরিষদ এমন দাবি করেছে। এ বাস্তবতায় শেয়ার বিক্রির জন্য সময়সীমা আরও ৩ বছর বাড়ানোর অনুরোধ জানালে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি তাদেরকে ৬ মাস সময় দিয়েছে। বিএসইসি ও ডিএসই সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইন স্টক এক্সচেঞ্জের ২৫ শতাংশ শেয়ার কৌশলগত বিনিয়োগকারীর কাছে বিক্রি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২০১৩ সালে প্রণীত এক্সচেঞ্জেস ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন আইনের মাধ্যমে স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনাকে আলাদা করা হয়েছে। এছাড়া অলাভজনক কোম্পানি থেকে স্টক এক্সচেঞ্জকে মুনাফামুখী কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। এ আইন অনুসারে স্টক এক্সচেঞ্জের ২৫ ভাগ শেয়ার কৌশলগত বিনিয়োগকারীর (Strategic Investor) কাছে বিক্রি করতে হবে।

আইনের শর্ত অনুসারে, ২০১৬ সালের মধ্যে ওই শেয়ার বিক্রির করার কথা ছিল। কিন্তু ক্রেতাদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না এমন অজুহাতে সময় বাড়ানোর আবেদন জানালে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) প্রথম দফায় এক বছর সময় বাড়িয়ে দেয়। গত ডিসেম্বরে ওই সময়সীমা শেষ হয়ে যায়। স্টক এক্সচেঞ্জের অনুরোধে আরেক দফা সময় বাড়িয়ে ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেও কার্যকর কোনো অগ্রতি না হওয়ায় স্টক এক্সচেঞ্জের অনুরোধে তৃতীয় বারের মতো সময় বাড়ানো হয়। এ দফায়ও সময় বাড়ানো হয় ৬ মাস।

জানা গেছে, গত মাসে ডিএসই কর্তৃপক্ষ শেয়ার বিক্রির সময়সীমা ৩ বছর বাড়াতে বিএসইসির কাছে আবেদন জানায়। বিষয়টি নিয়ে ২২ জুন ডিএসইর পরিচালনা পরিষদ বিএসইসির সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে বিএসইসির চেয়ারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন, কমিশনার অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন নিজামী, আমজাদ হোসেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ডিএসইর প্রতিনিধি দলে ছিলেন চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল হাশেম, পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান মিঞা, রকিবুর রহমান, শাকিল রিজভী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজেদুর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

বৈঠকে ডিএসইর পক্ষ থেকে সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরে ৩ বছর সময় বাড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়। জবাবে বিএসইসি ৬ মাস সময় বাড়াতে সম্মত হয়। তবে এখন পর্যন্ত সময় বাড়ানো বিষয়টি লিখিতভাবে স্টক এক্সচেঞ্জকে জানানো হয়নি।

জানা গেছে, সময় বাড়ানোর বিষয়টি কমিশন বৈঠকে অনুমোদন করা হবে। ডিএসই প্রতিনিধি দলের সাক্ষাতের পর বিএসইসির কোনো কমিশন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। সংস্থাটির চেয়ারম্যান ঈদের ছুটিতে বাইরে গিয়েছেন। তাই আগামী সপ্তাহের আগে কমিশন বৈঠকের সম্ভাবনা কম।

এদিকে বিএসইসি ৬ মাস সময় বাড়ানোর আশ্বাসের পাশাপাশি শেয়ার বিক্রির বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে ডিএসই প্রতিনিধি দলকে। শুধু শেয়ারের দরের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত না নিয়ে স্টক এক্সচেঞ্জের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারার যোগ্যতাকে বিবেচনায় রেখে ক্রেতা খোঁজার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা, ব্যবসা ও কারিগরি দক্ষতা বাড়াতে অবদান রাখতে পারবে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কাছেই শেয়ার বিক্রি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশি বা বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে আলাদাভাবে দেখার সুযোগ নেই। কোনো ক্রেতার যোগ্যতার ঘাটতি থাকলে যত বেশি দরই প্রস্তাব করুক না কেন তাদের কাছে শেয়ার বিক্রি করা যাবে না।

বৈঠকে ডিএসইর পর্ষদ জানায়, স্ট্র্যাটেজিক শেয়ারহোল্ডারের জন্য দুই দফা আগ্রহপত্র আহ্বান করলেও উল্লেখযোগ্য সাড়া পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ বার কিছু দেশীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান একাধিক গ্রুপে দরপ্রস্তাব করে। এর মধ্যে লংকাবাংলা ও ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ ডিএসইর ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারের জন্য সর্বোচ্চ সাড়ে ৩৩ টাকা দর প্রস্তাব করেছে। নরডিক দেশগুলোর ব্যবসায়ীদের সমন্বিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ব্রামার্স অ্যান্ড পার্টনার্সের নেতৃত্বাধীন একটি বিদেশি গ্রুপ দরপ্রস্তাব করেছে ১২ টাকা।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসইর একজন পরিচালক বলেন, আমাদের বাজারে লেনদেনের পরিমাণ খুবই কম। বাজার-গভীরতা নেই বললেই চলে। বাজারের একমাত্র প্রোডাক্ট হচ্ছে ইক্যুইটি শেয়ার। এখানে বন্ড, ডেরিভেটিভস, ইটিএফ ইত্যাদি কিছুই নেই। বাজারে গতি না থাকায় মুনাফাও তেমন ভালো নয়। এসব কারণে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হতে আগ্রহী নয় বিশ্বের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলো।

যে প্রস্তাবগুলো জমা পড়েছে সেগুলো বিবেচনা করা হচ্ছে না কেনো, সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকগুলো যৌক্তিক কারণ আছে। তিনি বলেন, উপযুক্ত দর প্রস্তাব করা হলে ব্রামার্সের বিষয়টি ভাবা যেতো। কিন্তু এতো কম দামে স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার বিক্রির কোনো সুযোগই নেই। অন্যদিকে লংকাবাংলা’র নেতৃত্বাধীন গ্রুপটির স্টক এক্সচেঞ্জ পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কৌশলগত বিনিয়োগকারী নিতে হবে কৌশলগত সুবিধার জন্য। ক্রেতার নিজের সক্ষমতা যদি প্রমাণিত না হয়, বিভিন্ন ধরনের প্রোডাক্ট সম্পর্কে যদি অভিজ্ঞতা না থাকে, তাহলে স্টক এক্সচেঞ্জ ও বাজার উন্নয়নে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না।

তিনি আরও বলেন, লংকাবাংলার ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি ঝুঁকিও আছে। প্রথমত: লংকাবাংলার তিনটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলো শেয়ারবাজারে ব্রোকারেজ, মার্চেন্ট ব্যাংকিং ও মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনাসহ নানা সেবা দিয়ে থাকে। তাই লংকাবাংলার নেতৃত্বাধীন গ্রুপ কৌশলগত বিনিয়োগকারী হলে স্বার্থের সংঘাত (Conflict of interest) দেখা দেওয়ার আশংকা থাকে।

অন্যদিকে আইন লংঘনের কারণে খোদ লংকাবাংলা ফাইন্যান্স ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান একাধিকবার জরিমানার মুখোমুখী হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। উপযুক্ত স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারের মাধ্যমে ডিএসইর ভাবমূর্তি উন্নয়নের যে সুযোগ তৈরি হওয়ার কথা, ওই ঘটনাগুলোর কারণে লংকাবাংলার মাধ্যমে তা হবে না।

তবে তিনি স্বীকার করেন, নিজ নিজ ব্যবসার ক্ষেত্রে লংকাবাংলা ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো করছে। মুনাফার ট্র্যাক রেকর্ড ভালো। আর প্রত্যেকটি কোম্পানি প্রযুক্তিকে ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে।

আজকের বাজার: এলকে/এলকে ১ জুলাই ২০১৭