তিন মাসের ঋণ এগারো বছরেও পরিশোধ করেননি নামীরা ট্রেডিংয়ের বাবুল

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের কোম্পানি (এনবিএফআই) বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি) থেকে ২০০৭ সালে তিন মাসের জন্য ২০ লাখ টাকার ঋণ নেয় নামীরা ট্রেডিং করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী আইনুল হক বাবুল। কিন্তু ১১ বছরেও সে ঋণ পরিশোধ করেননি তিনি।

ফলে সুদসহ সে ঋণ দাঁড়িয়েছে দেড় কোটিরও বেশি টাকায়। ঋণ খেলাপী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি হলেও তিনি রয়েছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

বিশ্বস্ত সুত্রে জানা যায়, ঋণ খেলাপী আইনুল হক বাবুল জামালপুর-৫ আসনের সাবেক সাংসদ  নিলুফার চৌধুরি মনি’র  স্বামী। একই সঙ্গে তিনি এই ঋণের জামিনদার । কয়েক দফায় চিঠি দেওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানটির ঋণের অর্থ পরিশোধ করছেন না বাবুল। তাই প্রতিষ্ঠানটি বাধ্য হয়েই আইনের আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হচ্ছেনা। আইনুল হক বাবুলের বিরুদ্বে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি হলেও তিনি রয়ে গেছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

বিলাসবহুল গাড়ি- বাড়ি ব্যবহার করলেও ফেরত  দিচ্ছেন না ঋণের টাকা। আর এরকম খেলাপী ঋণের কারণে অনেক চেষ্টার পরও ঘুড়ে দাঁড়াতে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৯৫ শতাংশই খেলাপী ঋণ।

সুত্রে জানা গেছে, আইনুল হক বাবুল ২০০৭ সালে ঋণ নেওয়ার পর থেকে তার বিপরীতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কোন টাকাই ফেরত দেয়নি। দফায় দফায় চিঠি দিয়ে এবং মিটিং করেও কোন কাজে আসেনি। তাই টাকা পরিশোধ না করায় ২০০৯ সালে তার বিরুদ্বে এন আই অ্যাক্ট আইনে প্রতিষ্ঠানটি মামলা করে। সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে আদালত মামলার রায় দেন এবং মামলায় বাবুল দোষী সাব্যস্থ হয়। যার ফলে বাবুলকে ২১ লাখ টাকা অর্থ দন্ড এবং অনাদায়ে ১ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেন বিজ্ঞ আদালত।

সুত্র আরো বলছে, আদালতের রায়ের পর তৎকালিন  বিআইএফসির কর্মকর্তাদের যোগসাজশে রায় কার্যকর স্থগিত করেন আইনুল হক বাবুল। বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (আবঃ) আব্দুল মান্নানের যোগসাজশে এরকম ঘঠনা ঘটেছে বলে বিশ্বস্ত সুত্রে জানা গেছে।

কারণ এই ঋনটি অনুমোদন হয় বিআইএফসির ৩৯তম বোর্ড সভায়। আর তখন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন মেজর (অবঃ) আব্দুল মান্নান। তার বিরুদ্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য। যার কারণে অনুসন্ধান শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৫ সালে বিআইএফসির পরিচালনা পরিষদ ভেঙে দেয় এবং নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হয়।

পরবর্তীতে ২০১৭ সালে বিআইএফসির নতুন পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার পর এই মামলা আবার খতিয়ে দেখা হয়। আদালত ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারীর ১৮ তারিখে আইনুল হক বাবুলের বিরুদ্বে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করে। কিন্তু তাতেও কোন কাজে আসছেনা। ঋণ খেলাপী আইনুল হক বাবুল গ্রেপ্তার না হওয়ায় আইন শৃংখলা বাহিনীর আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

এদিকে একাধিকবার চেষ্টা করেও আইনুল হক বাবুলের মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তার স্ত্রী ও এই ঋণের জামিনদার সাবেক সাংসদ নিলুফার চৌধুরি মনি’র সাথে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথমে এই ঋণের সাথে তার সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেন ।এক পর্যায়ে আজকের বাজারকে বলেন, দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে সেদিকে আপনারা নজর না দিয়ে এই ২০লাখ টাকার পিছনে লেগেছেন কেন?

তিনি আরও বলেন, আরো তিন মাস সময় বাড়ানোর জন্য কয়েকদিন আগে বিআইএফসির কাছে আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। ১১বছর পর আরো তিন মাস সময় বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছেন কেন? জানতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য না করেই ফোন রেখে দেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম আজকের বাজারকে বলেন, বিশ লাখ টাকার খেলাপী ঋণ ছোট বা সামান্য হলেও এটা যুক্তি দিয়ে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। একজন ডাকাতি করবে বলে অন্যজন বলবে যে তাকে চুরি করার অধিকার দেওয়া হোক! এইরকম যুক্তি দিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষই ইচ্ছাকৃতভাবে ঋন খেলাপী হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় বা অনেক সময় পরিচালকদের সম্পৃক্ততায়, বন্ধু এবং আত্বীয় স্বজন হিসেবে ঋণ দেওয়া হয়। ফলে খেলাপী ঋণের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ঋণ খেলাপীদের বিরুদ্বে কার্যকর কোন ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই দেশে খেলাপী ঋণের মাত্রা বেড়ে চলছে। সব মিলিয়ে রিসিডিউল করার পরেও ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরে খেলাপী ঋণের মাত্রা প্রায় ৯০হাজার কোটি টাকা। আগে সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপী ঋণ দেখা গেলেও এখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অহরহ দেখা যাচ্ছে। যার ফলে মানুষের আস্থা ব্যাংকিং সিস্টেমের প্রতি কমে যাচ্ছে। যা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে খুব ক্ষতিকর।

এবিষয়ে বিআইএফসি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) এম এম মোস্তফা বিলাল আজকের বাজারকে বলেন, তারা বিভিন্ন সময়ে মৌখিকভাবে সময় নিয়েও এ পর্যন্ত একটি টাকাও ফেরত দেয়নি। তবে কয়েকদিন আগে আইনুল হক বাবুল আরও তিন মাস সময়ের জন্য আবেদন করেছে। তাদের সাথে দফায় দফায় মিটিং করেও কোন কাজ হয়নি। এর আগেও অনেকবার সময় নিয়েছে, দেই দিচ্ছি বলে সময়ক্ষেপণ করছে।

তিনি আরও বলেন, এখন আর সময় বাড়ানোর সুযোগ নেই। আদালত থেকে আইনুল হক বাবুলের বিরুদ্বে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি হয়েছে। তাই আদালত থেকে জামিন নিয়ে তারপর এটা নিয়ে সময় বাড়ানো-কমানো বা সমঝোতা হতে পারে।

তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পাওয়ায় গ্রেপ্তারী পরওয়ানা জারির পরও আসামি গ্রেপ্তার হচ্ছেনা। ধানমন্ডি থানায় যোগাযোগ করলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয় আসামি পাওয়ারফুল অথবা বাসায় গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।

ধানমন্ডি থানার উপ-পরিদর্শক জায়েদ বিন সরওয়ার আজকের বাজারকে বলেন, আইনুল হক বাবুলের বিরুদ্বে গ্রেপ্তারী পরওয়ানা ধানমন্ডি থানায় আসছে কিন্তু আসামি পলাতক। তার ঠিকানামত তার বাসায় গিয়ে  তাকে পাওয়া যায়নি।

আজকের বাজার: জাকির/