দুর্নীতির চিত্র গোপনে ধারণ অপরাধ হবে না: আইনমন্ত্রী

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা কীভাবে গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য হয়রানিমূলক, সেটা জানেন না আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এই ধারার জন্য দুর্নীতি বা অপরাধের গোপন চিত্র ধারণ অপরাধ হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।

মঙ্গলবার ৩০ জানুয়ারি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী এ কথা বলেন। তিনি বলেন, গোপনীয়তা রক্ষার জন্য গুপ্তচরবৃত্তির আইন কোনো নতুন বিষয় না। এই ধরনের আইন আগেও ছিল। এবার ডিজিটাল আইনে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে মাত্র।

প্রস্তাবিত আইনটি সংসদের চলতি অধিবেশনেই তোলা হবে বলেও জানান মন্ত্রী।

‘দুর্নীতির চিত্র গোপনে ধারণ বৈধ’

এই ধারার কারণে দুর্নীতির চিত্র গোপনে ধারণে কোনো অপরাধ হবে না বলেও জানান আইনমন্ত্রী। বলেন, ‘একজনের দুর্নীতির ফাইল, ঘুষ লেনদের চিত্র ধারণ করলে বা অপরাধ প্রকাশ করলে কোনো অপরাধ হবে না।’

‘আপনি যদি কোনো দুর্নীতি বা অপরাধ প্রকাশ করেন, তাহলে আপনি সরকারকে সহযোগিতা করছেন, কোনো আইনে এটা অপরাধ হবে না, এটা আপনাদের আমি স্পষ্ট করে জানাতে চাই।’

সোমবার মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত বিধিবদ্ধ সংস্থার কোন গোপনীয় বা অতি গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার বা ডিজিটাল ডিভাইস বা কম্পিউটার নেটওয়ারর্কে ধারণ, প্রেরণ, সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন তাহলে সেটা হবে গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ।’

এই আইনে ১৪ বছরের কারাদণ্ড এবং ২৫ লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর এই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সাজা হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড হবে।

এই ধারাটির ফলে বিশেষ করে ডিজিটাল মাধ্যমে সাংবাদিকতা করা কঠিন হয়ে যাবে বলে সমালোচনা উঠেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকারের দুর্নীতি যেন ফাঁস না হয়, সে জন্যই এই আইন করা হচ্ছে।

’৩২ ধারা সাংবাদিকতা কঠিন করবে না’

৩২ ধারার কারণে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন না আইনমন্ত্রী। গণমাধ্যম কর্মীদের এক প্রশ্নের জবাবে ধারাটি পড়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা আমাকে বোঝান, এখানে সাংবাদিক কীভাবে হয়রানির শিকার হবে?’।

একজন গণমাধ্যম কর্মী বলেন, ‘আপনার সামনে একটি অতি গোপনীয় জিনিস ছবি তুললাম, আমি তো তাহলে অপরাধের সামিলের কাজ করলাম।’

পরে মন্ত্রী বলেন, ‘রাষ্ট্রের অতি গোপনীয় জিনিস চুরি করা বা নেয়া তো বর্তমান আইনেও অপরাধ। আমরা শুধু বলেছি, এটা ডিজিটাল সিস্টেমের মাধ্যমে যদি কেউ চুরিটা করে, তাহলে সেটা অপরাধ হবে।’

মন্ত্রী বলেন, ‘এই আইনের মধ্য যেটা করেছি ওই যে কম্পিউটার সিস্টেম বা ইনফরমেশন টেকনোলজির যে সিস্টেম ওই সিস্টেমটাকে ব্যবহার করে যদি কেউ গুপ্তচরবৃত্তি করে সেটা তাহলে একটা অপরাধ হবে। সেটার সঙ্গে সাংবাদিকতার কোনো সর্ম্পক আছে বলে আমার মনে হয় না। আমার মনে হয়, এটা অহেতুক ভীতি। আর সমালোচনার ক্ষেত্রে সমালোচনা করা।’

আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের নেত্রী। জনগণ মানে সাংবাদিক। তিনি অহেতুক অযথা কেউ হয়রানি হউক সেটা তিনি চান না।’

‘অতি গোপন বিষয়কি কি প্রকাশ করা যায়?’

অন্য এক প্রশ্নে আনিসুল হক বলেন, ‘কোনো জায়গায় যদি অতিগোপনীয়, গোপনীয় লেখা থাকে সাংবাদিক হিসেবে কি আপনার এক্সিজসিং আইনে সেটি প্রকাশ করতে পারেন? … ইট ইজ অ্যাবসিউলিটলি ইট ইজ অ্যান অফেন্স। তাহলে এটা হচ্ছে কম্পিউটারে ধারণ করা। আর আগে ছিল কম্পিউটার ছাড়া।’

বেরসকারি সংস্থাও যদি গোপনীয় বিষয় বলে ব্যবস্থা নেয়?- এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘বেসরকারি সংস্থারও গোপনীয় বিষয় থাকতে পারে। সেটি যদি কেউ চুরি করে। তাহলে এটা চুরির অপরাধের মধ্যে পড়ে। তবে অতি গোপনীয় জিনিস যদি কোনো ষড়যন্ত্রও হয় আর সেটা যদি আপনারা প্রকাশ করেন তাহলে তো কোনো অপরাধ হবে না।’

‘কিন্তু অতি গোপনীয় জিসিনটা যদি সঠিক হয় সেটা বেসরকারি সংস্থা বলেন আর সরকারি সংস্থা বলেন সেটা যদি তারা গোপনীয় রাখতে চান আর সেটা যদি পরিষ্কারভাবে লেখা থাকে তাহলে সেটা প্রকাশ করা ঠিক হবে না।’

দণ্ডবিধিতে থাকলে গুপ্তচরবৃত্তির বিষয়টি ডিজিটাল নিরাপত্তা নিরাপত্তা আইনে কেন আনতে হলো- এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘দণ্ডবিধিতে যেটা আছে সেটা হলো কম্পিউটার ছাড়া যেসব অপরাধ। ধরেন মানহানি যদি করেন তাহলে দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারা আছে। সেটা ডিফাইন করে মানহানি কী। এখন কম্পিউটারে যদি মানহানি করেন তাহলে পরে তারা বলবে আমি তো কম্পিউটারের মাধ্যমে করেছি এটা তো প্যানাল কোডে নেই। তার মানি আমি কোনো অপরাধ করিনি। সেই জন্য কম্পিউটারে যদি মানহানি করা হয় সেটাকে সাইবার ক্রাইম হিসেবে ধরে ডেফিনেশন দেয়া হয়েছে।’

‘৫৭ ধারার মতো অপপ্রয়োগ বন্ধ হবে’

তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাটি অস্পষ্ট ছিল বলে মনে করেন আইনমন্ত্রী। আর নতুন আইনে সবগুলো বিষয় স্পষ্ট হওয়ায় অপপ্রয়োগ বন্ধ হবে বলে আশা করছেন তিনি।

মন্ত্রী বলেন, ‘পৃথিবীর যত অপরাধ সব আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় আনা হয়েছে। এখানে অস্পষ্টতা ছিল। … আপনাদের (সাংবাদিক) শঙ্কা ছিল। এটার ল্যাংগুয়েজটা এমনভাবে ছিল যে ছোট খাটো অপরাধ করলেও নূন্যতম সাত বছর কারাদণ্ড দেয়া যেত।’

‘সেই শঙ্কা এবং ভীতি কিন্তু আমরা দূর করেছি। এটার ব্যাপারে কিন্তু সব কিছু পরিষ্কার।’

মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সবেচেয়ে বড় ইচ্ছা অপপ্রয়োগ বন্ধ করা। আমাদের বিশ্বাস এই আইনের স্পষ্টতার কারণে অপপ্রয়োগ বন্ধ হবে। ৫৭ ধারার যে অপপ্রয়োগ হয়েছিল সেটার অপপ্রয়োগ বন্ধ হবে।’

মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অপপ্রচার প্রসঙ্গ

আইনে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অপপ্রচারেও কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যদি কেউ হেয় করার চেষ্টা করে, যেটা করার চেষ্টা করা হয়েছিল ২১ বছর। তার নাম নিলে তখন অন্যায় হতো। এরকম একটা কালচার চলচিল। সেই কালচারের বিপরীতে আজকে আমরা মনে করেছি এই আইনটা থাকা দরকার। ওই কালচার থেকে বেরিয়ে আসার একটা সময় হয়েছে।’

‘আপনারা শুনেছেন মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ হয়নি। এরকম কথাও তো আজকে আমাদের শুনতে হচ্ছে। এরকম অবস্থা বন্ধ করার জন্য এই আইনটা করা হয়েছে। কেউ যদি এরকমটা না করেন তাহলে তো তিনি এর মধ্যে পড়বেন না। এখানে বিচারের স্বচ্ছতা রাখা হয়েছে।’

আজকের বাজার:এলকে/ ২৯ জানুয়ারি ২০১৮