নাটোরের ধান মাড়াই কলের চাহিদা দেশজুড়ে

স্থানীয় ওয়ার্কশপে ধান মাড়াই কল

চলনবিল অধ্যুষিত কৃষি প্রধান জেলা নাটোর। এ জেলায় চলতি মৌসুমের বোরো ধানকে ঘিরে চাষিদের মধ্যে চলছে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। ফলে এলাকাজুড়ে শুরু হয়েছে উৎসবের আমেজ। এর সঙ্গে বাড়তি খুশি যোগ করেছে স্থানীয়ভাবে তৈরি ‘ধান মাড়াই কল’।

ধানের মৌসুমে একই সঙ্গে যখন অনেকধান বাড়িতে আসে, তখন তা মাড়াই করা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান কৃষকরা। সেই চিন্তা থেকে মুক্তি দিতেই প্রস্তুত করা হয় ‘ধান মাড়াই কল’। স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকৃত এই কল ইতিমধ্যে জেলার কৃষকদের চাহিদা মিটিয়েছে। পার্শ্ববর্তী জেলার কৃষকরাও ঝুঁকছেন এই কলের দিকে। ফলে দেশজুড়ে বাড়ছে চাহিদা।

জানা যায়, গত ২০-২৫ বছর ধরে এই জেলায় সুনামের সঙ্গে তৈরি হচ্ছে ধান মাড়ই কল। একই সঙ্গে প্রস্তুতকারীরা ব্যবসাও করছেন সুনামের সঙ্গে। এই কল প্রস্তুত করতে ব্যবহার করা হয় বাবলা কাঠ, ঢালাই লোহার চাকতি, বেয়ারিংসহ দুই-তিনটি যন্ত্রাংশ। তবে বর্তমানে বাবলা কাঠের দুস্প্রাপতা, শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধি, ব্যাংক ঋণ পেতে হয়রানিসহ নানা কারণে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে এই শিল্পের বিকাশ। এর মাঝেও থেমে নেই এই অগ্রযাত্রা।

এই কলের মাধ্যমে কৃষকরা যেমন নিজের ধান মাড়াই করতে পারেন, তেমনি অন্যের ধান মাড়াইয়ের জন্য ভাড়া দিতে পারেন। ফলে এর মাধ্যমে পাওয়া যায় বাড়তি টাকা।

জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ২০ থেকে ২৫টি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে ধান মাড়াই কল তৈরি হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে এই কলকে বলা হয় ‘থেসার’। জেলার ২০-২৫টি ওয়ার্কশপ ছাড়াও সদরের ৭ টি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে কল প্রস্তুত করা হচ্ছে।

জেলাজুড়ে থেসারের যে চাহিদা রয়েছে, তার সিংহভাগই পুরণ করে সদরের ৭টি ওয়ার্কশপ। আর উপজেলা পর্যায়ে কিছু সংখ্যক ওয়ার্কশপে থেসার তৈরি হলেও মূলত মেরামতের কাজেই বেশি ব্যবহার হয়। এসব উৎপাদন ও বিক্রয়কারী  প্রতিষ্ঠান ধান উত্তোলন মৌসুমে  প্রায় ৮০০-৯০০টি  ধান  মাড়াই কল বিক্রি করে।

এই কলের মাধ্যমে বিগত বছরগুলোতে ধান মাড়াই করে সুফল পেয়েছেন এমন কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এর মাধ্যমে তুলনামূলক স্বল্প সময়ে এবং শ্রমে ধান মাড়াই করা যায়। আবার নিজের ধান মাড়াই করার পর অন্যের কাছে ভাড়াও দেওয়া যায়।

মাধনগরের কৃষক আমিনুল জানান, ধানমাড়াই কল দিয়ে সহজে ধান মাড়াই করা যায়। এতে গরু কিংবা মহিষের প্রয়োজন পরে না। নির্দিষ্ট মজুরির মাধ্যমে পায়ে ঠেলে কিংবা শ্যালো মেশিনের সাহায্যে অল্প পরিশ্রমে ধান মাড়াই করা যায়। তাই  আমরা অটোমেটিক থেসার মেশিন কিংবা তুলনামূলক কম দামের এই সব ধানমাড়াই কল দিয়ে ধান মাড়াই করে থাকি।

ধান মাড়াই কল দেখছেন ক্রেতারা

বড়াইগ্রামের কৃষক নিজাম উদ্দিন জানান, যে গুলো বেশি দামি অটোমেটিক থেসার মেশিন, সেগুলোতে ধান মাড়াই করলে খড় নষ্ট হয়ে যায়। ওই খড় গরু-মহিষ খেতে চায় না। তাই তিনি সাধ্যের মধ্যে থাকা ৫ হাজার টাকায় এই ধান মাড়াই কলটি কিনে ধান মাড়াই করছেন।

চাহিদা এবং টেকসইগত সুনাম থাকলেও পুঁজির অভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারছেন না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। উৎপাদনকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাঠ ও লোহা দুই ধরনের ফ্রেমে তৈরী ধানমাড়াই কল আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত। গ্রাহকদের পছন্দমতো পা-দানীসহ কিংবা শ্যালো মেশিন ব্যবহারের উপযোগী করে তৈরী করা হয় এই মাড়াই কল।

জি কে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের স্বত্ত্বাধিকারী গোবিন্দ কর্মকার বলেন, স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ার নারায়ণ বাবুর কাছ থেকে আমি কাজ শিখেছি। এরপর প্রায় ১৮ থেকে ২০ বছর ধরে নিজেই ধানমাড়াই কল তৈরী ও বিক্রি করছি। আমি ছাড়াও আমার সহযোগী হিসেবে কাজ করছে ৬ থেকে ৭ জন।

তিনি বলেন, পুঁজির অভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বড় করতে পারছিনা। সহজে ও স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ পেলে প্রতিষ্ঠানটি বড় করে আরও জনবল নিয়োগ দিতে পারতাম। এতে একদিকে মাড়াই কল বেশি তৈরি করে কৃষকদের সহযোগিতা করা যেত, পাশাপাশি কিছু বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতো।

নাটোর জেলা শহরের এ আর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক আশরাফুল ইসলাম বলেন, এবারের বর্ষায় ব্যবসায় মন্দাভাব যাচ্ছে, ধানমাড়াই কল তৈরিতে ব্যবহৃত বাবলা কাঠের সংকট ও দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমিকের মজুরিও দিতে হচ্ছে অনেক বেশি। তাই ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও বেশি কল উৎপাদন করতে পারছিনা।

তিনি বলেন, এটা এখন আর ছোট শিল্প নয়। নাটোরের চাহিদা মিটিয়ে পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটি জেলায় এর বাজার তৈরি হয়েছে। ফলে দিনদিন চাহিদা বাড়ছেই। কিন্তু পুঁজি স্বল্পতার কারণে চাহিদা মতো যোগান  দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা।

স্থানীয় একটি ওয়ার্কশপের মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উচ্চ সুদে স্থানীয় এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এসব থেসার উৎপাদন করছি। কিন্তু আমরা তা চাইনা। বেশি সুদে ঋণ নিচ্ছি বলেই থেসার বিক্রির সময় আমাদের কিছুটা বেশি দাম রাখতে হচ্ছে। ফলে কৃষকদের ক্রয় ক্ষমতার সঙ্গে অনেক সময় সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছেনা।

তিনি বলে, এসব কৃষি পণ্য তৈরির উপর স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ পেলে বড় উপকার হতো। তখন সারা দেশে আমরা স্বচ্ছন্দে মাড়াইকল পৌঁছে দিতে পারতাম।

 

আরএম/রাসেল/