পদ্মা সেতু তৈরিতে সময় ও ব্যয় বাড়বে

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অর্থ্যাৎ ২০১৮ সালের মধ্যে বহু প্রত্যাশিত পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাজের যে অগ্রগতি তাতে নির্ধারিত সময়ে এই সেতু চালু হওয়া দু:সাধ্য ব্যাপার। সময় বৃদ্ধির সঙ্গে সেতুর নির্মাণ ব্যয়ও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তবে কী পরিমান ব্যয় বাড়বে তা বলা যাচ্ছে না এখনই। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, তিন ভাগের এক ভাগ গুরুত্বপূর্ণ পাইল বসানোর বিষয়ে এখনো কারিগরি জটিলতা রয়ে গেছে। ফলে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা বেশ কঠিন হবে।

সেতু বিভাগ জানায়, পদ্মা সেতুর পুরো কাজকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো-মূল সেতু, নদী শাসন, জাজিরা সংযোগ সড়ক নির্মাণ, মাওয়া সংযোগ সড়ক নির্মাণ এবং সার্ভিস এরিয়া-২ এর আওতায় অবকাঠামো উন্নয়ন ও টোল প্লাজা মির্মাণ।

ডিসেম্বর পর্যন্ত মূল সেতুর কাজ অর্ধেক এবং নদী শাসনের কাজ প্রায় ৩৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি কাজগুলো প্রায় সমাপ্ত। সবমিলে প্রকল্পের কাজ হয়েছে ৫০ শতাংশ। বর্তমানে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে মূল সেতুর কাজ প্রায় ২৫ শতাংশ এবং নদী শাসন কাজ পিছিয়ে আছে প্রায় ৩০ শতাংশ। আর নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আট মাস পিছিয়ে আছে নির্মাণ কাজ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২০১৪ সালের জুনে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণে চুক্তি সই হয়। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের নভেম্বরের মধ্যে। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হচ্ছে না। মূল সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ করতে অতিরিক্ত ২৩ মাস সময় চেয়ে চিঠি দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। যদিও প্রকল্পটির কাজ দ্রæত এগিয়ে নিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ গেল নভেম্বরে সাড়ে তিন হাজার কিলোজুল ক্ষমতার একটি হ্যামার যুক্ত করেছে।

অন্যদিকে নদী শাসন শেষ করতে অতিরিক্ত ১৮ মাস সময় চেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন। তবে এর কোনো ব্যাখ্যা না দেওয়ায় প্রস্তাবটি ফেরত দিয়েছে বিবিএ।

এদিকে মাঝনদী ও মাওয়া প্রান্তে ১৪টি পিলারের নিচে ৮৪ টি পাইল বসানো নিয়ে কারিগরি জটিলতা তৈরি হয়েছে। কয়েকমাস আগে থেকেই বিশেষজ্ঞ কমিটি এই জটিলতার সমাধান কী হতে পারে তা নিয়ে কাজ করছেন।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের পিলারের নিচে বিশ্বের সর্বোচ্চ ৯৮ থেকে ১২৮ মিটার পর্যন্ত গভীর পাইল বসানো হচ্ছে। ১৪টি পিলারের নিচে যে গভীরতায় পাইল বসানোর কথা, এর ৩ থেকে ৭ মিটার ওপরে কাদামাটি পাওয়া গেছে। সাধারণত কাদামাটির স্তরের ওপরে থাকা শক্ত মাটিতে পাইলের শেষাংশ থাকা বাঞ্ছনীয়। এ জন্যই এই ৮৪টি পাইল আরও গভীরে বসানো হবে, নাকি গভীরতা কমিয়ে সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া হবে-এটা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় আছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। মাটি থেকে পানি পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় পিলারের চারপাশে বেড়া দিয়েও এর সমাধান হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

চলতি মাসেই এর সমাধান হতে পারে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ মাসে সিদ্ধান্ত না পেলে কাজ অনেক পিছিয়ে যেতে পারে। কারণ এই অংশে বেশি গভীরতা ও খরস্রোতার কারণে বর্ষাকালের বৈরী আবহাওয়ায় কাজ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।

মূল সেতুতে মোট পিলার হবে ৪২টি। দুটি পিলারের মধ্যবর্তী দূরত্ব ১৫০ মিটার। এই দূরত্বের লম্বা ইস্পাতের কাঠামো বা স্প্যান জোড়া দিয়েই সেতু নির্মিত হবে। চীনে তৈরি প্রতিটি স্প্যানের ক্ষুদ্রাংশ সমুদ্রপথে জাহাজে করে দেশে আনা হয়। সেখান থেকে মাওয়ার কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে নিয়ে তা ফিটিং করা হয়।

গত সেপ্টেম্বরে জাজিরা প্রান্তে দুটি পিলারের মধ্যে একটি স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে পদ্মা সেতু। আরও ৩ টি স্প্যান সেতুতে বসানোর প্রস্তুতি প্রায় শেষ। চলতি মাসে অন্তত দুটি স্প্যান বসানোর লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। বাকি স্প্যানের মধ্যে ১১ টি ‘কন্সট্রাকশন সাইটে’ পৌছেছে, ৭ টি স্প্যানের জোড়া লাগানোর কাজ চলছে মাওয়ায়।

এছাড়া ১২টি স্প্যান চীন থেকে শিপমেন্টের জন্য প্রস্তুত রয়েছে, অবশিষ্ট ৭ টি স্প্যান তৈরির কাজ চলছে চীনে।

পদ্মা সেতুর প্রতিটি পিলারের নিচে ছয়টি করে পাইল বসানো হচ্ছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৪০টি স্টিলের পাইলের মধ্যে ২০ টির নীচের অংশ, ৭৪ টির উপরের অংশের কাজ শেষ হয়েছে। পুরো কাজ শেষ হয়েছে ২৮ টির। এছাড়া চারটি পিলারের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। ঘন কুয়াশার কারণে কাজ আশানুরূপ এগুচ্ছে না বলে জানালেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা।

এমন পরিস্থিতিতে পদ্মা সেতুর ব্যয় আবার এক দফা বাড়ছে। সেতুটি বাস্তবায়নে ২০০৭ সালে একনেকে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদিত হয়। এরপর দুই দফা সংশোধনের পর তা ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এর মধ্যে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। এখন জমি অধিগ্রহণের জন্য আরও ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বাড়তি যুক্ত হচ্ছে।

এতে মোট ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে মূল প্রকল্প প্রস্তাব থেকে ব্যয় বেড়েছে ২০ হাজার ৩১ কোটি ২৫ লাখ টাকা।

সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, নদী শাসনের জন্য প্রথমে নদীর ডুবোচরে বালু ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল এবং এসব জমি খাস হিসেবে বিবেচনা করেছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বালু ফেলতে গেলে স্থানীয় লোকজন স্থাপনা নির্মাণ করে ও চাষাবাদ শুরু করে দিয়ে মালিকানা দাবি করেন।

তখন সরকার প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে ব্যয় বেড়ে যায় ১ হাজার ৪শ কোটি টাকা। এই কাজে আরও জমির প্রয়োজন হতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে। সেক্ষেত্রে ব্যয় আরও বাড়বে। এছাড়া মাঝনদী ও মাওয়া প্রান্তে পাইলিং নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তার জন্যও পুনরায় ব্যয় বাড়তে পারে।

কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মা সেতুর স্থায়ীত্ব ১০০ বছর ধরা হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে এত বড় ও জটিল স্থাপনার কাজ তাড়াহুড়ো করে শেষ করা মোটেও ঠিক হবে না।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রমত্তা পদ্মার প্রবল স্রোত ও ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে চলছে নির্মাণযজ্ঞ। সেতুতে যে গভীরতায় পাইল বসানো হচ্ছে, তা বিশ্বে রেকর্ড। নদী শাসনের কাজটাও বেশ জটিল। ফলে কারিগরি নানা চ্যালেঞ্জ আসছে।

৮৪টি পাইলের বিষয়ে নতুন করে নকশা করতে হচ্ছে। এই নকশা এবং সেই অনুযায়ী পাইল বসানোর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তবে সময়মতো সেতু চালু করার লক্ষ্য নিয়েই তাঁরা কাজ করছেন।

ঠিকাদারদের বাড়তি সময়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, তাদের বাড়তি সময় দেওয়া হয়নি। সময়মতো এই সেতু চালু করার লক্ষ্যে সবাই মিলে প্রানপন চেষ্টা করা হচ্ছে।

৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বিতল এই সেতুর উপর দিয়ে চলবে যানবাহন আর নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। পদ্মা সেতুর রঙ হবে সোনালি। তবে রাতে সেতুটিতে জ্বলবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার রঙ লাল ও সবুজ বাতি।

আজকের বাজার: এনএল/ এসএস ৬ জানুয়ারি ২০১৮