বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে সংশোধন দরকার

পুঁজিবাজার অভিমত

শামসুল হুদা: বিদায়ী বছর জুড়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারকে সুন্দরভাবেই নিয়ন্ত্রণ করেছে। কারণ আমরা যদি সারা বছরের চুলচেরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাব যে এ বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বাজারের সূচক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ২০ পারসেন্ট সূচকে ও ২০ পারসেন্ট আইপিওতে। এর মধ্যে ২০২৮ কোটি টাকা ক্যাপিটাল মার্কেট গেইন করলো। এভাবে আমরা দেখেছি মূল সুচক ১০ পারসেন্ট বেড়েছে। এটা কিন্ত খুবই ইতিবাচক। যদি এখানে দুশো তিনশো পারসেন্ট বেড়ে যেত তাহলে সেটা বাজারের জন্য খারাপ হতো। এর জন্য বাজারে কোন গ্যাপ সৃষ্টি হয় নি। এর মাধ্যমে আইপিও এবং স্বাভাবিক মাত্রায় উত্থানের মাধ্যমে বাজার একটা স্থিতিশীলতার মধ্যে দিয়ে গেল। এটাকে আমরা অবশ্যই একটা ভালো অর্জন বলতে পারি। কারণ অতীতে তো আমরা দেখেছি যে বাজার পড়ে তো পড়েই, আর উঠছে না। কিন্ত এবারেই আমরা দেখলাম যে বাজার পড়ে গেলেও আবার সেটা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে গেল বছর আমাদের পুঁজিবাজারের সূচক ওঠা-নামা এবং নিয়ন্ত্রন স্বাভাবিক এবং ভালো ছিল বলে আমি মনে করি।

তবে বিদায়ী বছরে পুঁজিবাজারের আলোচিত বিষয়ের মধ্যে ছিল আইপিওতে বুকবিল্ডিং পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে কিছু ফাঁক-ফোকর থাকায় একটি চক্র এটার অপব্যবহার করেছে বলে মনে হয়েছে। যার কারণে সিন্ডিকেট করে বিডিং করার মাধ্যমে অতিরিক্ত মূল্যে বাজারে আইপিও আসছে।
আমি ৯৮ সালের দিকে বুকবিল্ডিং পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা শুরু করি। এর পর থেকে এ পদ্ধতিটা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বুকবিল্ডিং পদ্ধতি নিয়ে আমার কিছু মতামত আছে। আইপিওতে আসার পর বাজারে লেনদেনের সময় সার্কিট ব্রেকার দেয়া, যাতে প্রথম দিন ২০ শতাংশের বেশি মূল্য বাড়তে না পারে। পাশাপাশি লকিং সিস্টেম বাতিল করে দিলে বাজারে শেয়ারের সাপ্লাই বেশি থাকবে। তাহলে এই পদ্ধতির ভাল সুফল পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি।

আইপিও যে প্রসেসেই যায় সে প্রসেসে আমরা দেখেছি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে অনেক আগে বিভিন্ন ধরণের দুর্নীতি হয়েছে। সে অবস্থার প্রেক্ষাপটে ব্যাবস্থাপনার যে ফাঁক ফোকর ছিল সেগুলো কিন্ত আমাদের জানা। যেহেতু এগুলো পত্র পত্রিকায় আসছে। আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যার্থতা যে আমরা জেনেশুনেও এই ব্যাপারটাকে পলিসি ম্যাটার দিয়ে কাভারআপ করতে পারিনি।

আমাদের আইপিওতে যে ব্যাপরটা হয় সেটা একটা ব্যন্ডউইথ বেধে দেয়া উচিৎ। যেহেতু আমাদের মার্কেট পুরোপুরি ম্যাচিউর্ড না বা আমাদের বিনিয়োগকারীরাও যথেষ্ট ম্যাচিউর্ড না। ব্যান্ডউইথ যদি বেধে না দেয় হয় সেক্ষেত্রে দেখা যাবে দুএকটা ট্রানজেকশন হওয়ার পর হঠাৎকরে বাজারটা অনেক বাড়িয়ে দিল। সেখান থেকে তারা মেজারমেন্টটা করবে। তখন কিন্ত মূল্য বাড়ার দিকেই থাকবে কমের দিকে থাকবে না। কিন্ত বেধে দেয়া হলে সেটা একটা নিয়োমের মধ্যে চলে আসবে। ফলে প্রাইস একটা অবস্থানের উপরে আর যাবে না। সার্কিটব্রেকার সেটাকে আটকে দেবে।
তাছাড়া একটা শেয়ারে যে ব্রেকআপ ভ্যালু আছে তার ২০ পারসেন্ট এপ্রিশিয়েট করতে পারবো। সে ভ্যালুর উপর আমরা ২০ পারসেন্ট যেতে পারি। তাহলে রেট অব রিটার্ণটা ভালো থাকবে। নাম না বলে একটা শেয়ারের কথা বলি, যার প্রাইজ এতো বেড়ে গেছে তার রেট অব রিটার্ণ কিন্ত সেভাবে আসবে না।

এখানে আরো কিছু লিকেজ রয়ে গেছে তা হলো সমন্বয়ের অভাব। যেমন একটা কোম্পানি যদি আইপিওতে আসতে চায় ক্রেডিট রেটিংটা হাই হতে হয়। প্রি আইপিওতে প্রচুর হোম ওয়ার্ক থাকে। আমরা কিন্ত এই হোম ওয়ার্কে কোনই নজর দিচ্ছি না। আমরা সেটা এড়িয়ে যাচ্ছি। এটা ঠিক নয়। আমাদের অবশ্যই প্রি আইপিও হোম ওয়ার্কটা করতে হবে। সেটা হলো বিভিন্ন ধরণের বিচার বিশ্লেষন। সে কতখানি কমপ্লায়েন্স সেটা বিবেচনা করা। এগুলোকে জাস্টিফাই করতে হলে তার ক্রেডিট রেটিং লাগবে। এর ভেতর তার ম্যানেজম্যান্ট কমú­ায়েন্স থাকতে হবে। তার নূন্যতম তিন বছরের ক্রেডিট রেটিংয়ের যে মূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে, তার সাথে তার আয়ের রেটিংটা সবার সামনে প্রকাশ করতে হবে। প্রতিবছর সে কতটা পুঁজি বিনিয়োগ করছে সেটা সামনে আনতে হবে। না হলে বিনিয়োগকারীরা সঠিক হিসেব পাবে না।

ইউরোপ বা আমেরিকায় একটা কোম্পানী তিনশ চারশ বছর ধরে চলছে। সেখানে তো আর মালিক নাই, মালিক অনুপস্থিত। একমাত্র গুড গভর্নেন্স এর মাধ্যমেই সফলভাবে সেটা চলছে। এবং এর মাধমে তাদের আয়ও হচ্ছে। এখানে গুড গভর্নেন্স রয়েছে। ওখানে যেসব সিইও অন্যায় করেছে, তথ্য গোপন করেছে তাদের শাস্তি হয়েছে। কিন্ত আমাদের দেশে দেখা যায় এজন্য কোন শাস্তির ব্যবস্থা নাই। এবং এর জন্য সুস্পষ্ট কোন আইনও নাই। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি কিন্ত পাবলিকের সম্পদ, এটা কারো ব্যাক্তিগত সম্পদ না। জনগণের সম্পদের রক্ষা ও ব্যাবস্থাপনার জন্য একটা গভর্নিং বডি রয়েছে। তারাই এর দেখাশোনা করবে। জবাবদিহিতা করবে।

শামসুল হুদা
ব্যাবস্থাপনা পরিচালক
এএনএফ ম্যানেজমেন্ট কোং লিমিটেড