ভাষা আন্দোলনের উত্তাল স্রোতধারায় নাটোর

৫২’র ভাষা আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় শাসকের রক্ত চোখকে উপেক্ষা করে ভঙ্গ করা হয় ১৪৪ ধারা, রক্তাক্ত হয় রাজপথ। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের মিছিল আর সমাবেশে উত্তাল হয়ে ওঠে নাটোরের রাজপথ। এ আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন নাটোরের ভাষা সৈনিক ফজলুল হক।

ভাষা সৈনিক ফজলুল হক তৎকালীন জিন্নাহ মেমোরিয়াল বয়েজ হাইস্কুলের(বর্তমানে নাটোর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়)নবম শ্রেণীর ছাত্র এবং স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলেন। ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে স্কুলে যেয়ে সকল ক্লাস ক্যাপ্টেনদের সাথে ভাষা আন্দোলনের পরিস্থিতি নিয়ে পরামর্শ সভা আয়োজন করেন তিনি। সিদ্ধান্ত হয়, তিনটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে শহরে মিছিল হবে, হবে সমাবেশ। জিন্নাহ মোমোরিয়াল বয়েজ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। ফজলুল হকের নেতৃত্বে সকল ক্লাস ক্যাপ্টেন প্রধান শিক্ষকের কাছে যেয়ে শহরে মিছিল করার অনুমতি প্রার্থনা করে। অনুমতি পেয়ে স্কুলের প্রায় দেড়শ’শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে মিছিলটি আলাইপুর হয়ে নাটোর গার্লস হাইস্কুলে(বর্তমানে নাটোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়)যায়। উদ্দেশ্য, মিছিলে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ। স্কুলের ক্যাপ্টেন শামসুন নাহার ছিলেন ফজলুল হকের পূর্ব পরিচিত। শামসুন নাহার রাজী হলেও বাঁধ সাধেন প্রধান শিক্ষিকা সুকুমারী দেবী। প্রধান শিক্ষিকার ভাষা আন্দোলনের সাথে ঐক্যমত্য পোষণ করলেও ছাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। ফজলুল হক এ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলে ছাত্রীদের মিছিলে যাওয়ার অনুমতি মেলে। দুইটি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের‘রাষ্ট্র্রভাষা বাংলা চাই’স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয় শহরের প্রধান প্রধান সড়ক। লালবাজার হয়ে মিছিল যেয়ে পৌঁছে উপর বাজার এলাকায় মহারাজা জগদিন্দ্র নাথ হাইস্কুলে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক গিরিজাশংকর চৌধুরীর অনুমতি পেয়ে শিক্ষার্থীদের যৌথ মিছিল হয়ে ওঠে সম্মিলিত। কাপুড়িয়াপট্টির পথ ধরে কাচারি রোড ধরে মিছিলটি পৌঁছে যায় চৌধুরী বাড়ির কামান সংলগ্ন আম বাগানে। বস্তুত ঐ সময়ে সকল আন্দোলন-সংগ্রামের সমাবেশ কেন্দ্র ছিল এ আম বাগান। শিক্ষার্থীদের এ সমাবেশে ফজলুল হক সভা প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। সমাবেশে বক্তব্য রোখেন বরেণ্য সাহিত্যিক ও পরে নাটোর পিটিআই সুপারিনটেনডেন্ট জিয়াউল হক, দৌলতুজ্জামান, ফজলুল হক শাহ, মহারাজা স্কুলের ক্যাপ্টেন তরুণ রায় প্রমূখ।

একসময় পুলিশ আসলে আতংক ছড়িয়ে পড়ে সমাবেশে। গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরে মায়ের বকুনী এখনো কানে বাজে বলে জানান ফজলুল হক। খবর ছড়িয়ে পড়ে, আন্দোলনকারীদের নামে পুলিশ হুলিয়া জারি করেছে। তাই ফজলুল হকের সাথে অনেকেই এক সপ্তাহের আত্মগোপনে চলে যান নাটোরের পিপরুল গ্রামে। কিন্তু এ খবর গুজব জানতে পেরে তাঁরা ফিরে আসেন শহরে। আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে এবং তমদ্দুন মজলিশের সহযোগিতায় শহরে ভাষা আন্দোলন শুরু হলে ঐসব কর্মসূচীর পোষ্টার, মাইকিংসহ প্রচারণার মূল দায়িত্ব পালন করেন ফজলুল হকের নেতৃত্বে একদল শিক্ষার্থী। ঐসময়ে নাটোর শহরে কোন কলেজ না থাকায় স্কুলের শিক্ষার্থীরাই ভাষা আন্দোলনের পুরোধা শক্তি ছিল।

আগুন ঝরা ঐসব দিনের আন্দোলন পূর্ণতা পেয়েছে, বাংলা হয়েছে রাষ্ট্রভাষা, পরবর্ত্তীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে শহীদ দিবসের স্বীকৃতি-এসব আমাদের অনন্য অর্জন বলে প্রশান্তির কথা জানালেন নাটোরের ভাষা সৈনিক ফজলুল হক। ফজলুল হককে নাটোর সরকারি বালক বিদ্যালয় ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত শতবর্ষ উৎসবে ভাষা আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা রাখায় সম্মাননা প্রদান করেছে। জেলা বোর্ডের সেকশন অফিসার হিসেবে সরকারি চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে ফজলুল হক দীর্ঘদিন ধরে নাটোরের ওষুধ ব্যবসায় করছেন। বর্তমানে ৮২ বছর বয়সেও পড়াশোনার নেশায় ডুবে থাকা ৮০’র দশকে নাটোরে প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র‘প্রকাশ’এর পাবলিকেশন্স বোর্ডের সদস্য ছিলেন ফজলুল হক। ভাষা সৈনিক ফজলুল হকের শতায়ু কামনা করেছেন নাটোর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম ও নাটোর প্রেসক্লাবের সভাপতি জালাল উদ্দিন। তথ্য-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান