ভয়ঙ্কর বিয়ে!

পাত্র মনসুর হারাত খান, পাত্রী নুপূর সিঙ্ঘলএখনও বিয়ের শামিয়ানা খোলা হয়নি। রোববার সকালে ছিল বিয়ের অনুষ্ঠান। সন্ধ্যায় ভোজসভা। সোমবার ৩০ বছরের পাত্র ভারতের কবিনগরের ছোট ফ্ল্যাটের ভেতের চেয়ারে বসে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আল্লাহ দয়াময়, এমন ভয়ঙ্কর বিয়ে যেন কারো না হয়!

সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মনসুর হারাত খান এখন এই শিল্পশহরের বাসিন্দা। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ’র ছাত্র তিনি। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এইচআর ম্যানেজার। তার কান্না দেখে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছিল।

যুবকটির অপরাধ, তিনি বিয়ে করেছেন ২৮ বছরের এক হিন্দু পাত্রী নুপূর সিঙ্ঘলকে। পাত্রী পেশায় মনোচিকিৎসক। রোববার বিশেষ বিবাহ আইন অনুসারে গাজিয়াবাদ আদালতে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। সন্ধ্যায় রাজনগরে মেয়ের বাড়িতে ছিল বিয়ের রিসেপশন।

কোথাও কোনো গোলমাল ছিল না। কিন্তু খোঁজ রাখছিল হিন্দুত্বের স্বনিযুক্ত ঠিকাদাররা। দুপুর বারোটাতেই মেয়ের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ শুরু হয়। বজরং দল, হিন্দু রক্ষা দল, ধর্ম জাগরণ মঞ্চ ইত্যাদি নানা গোষ্ঠীর লোকজন তাতে ছিল বলে অভিযোগ।

কিন্তু ‘ফ্রিঞ্জ গ্রুপ’-এর দৌরাত্ম্য বলা যাবে না। কারণ, তাদের সঙ্গে হাজির ছিলেন বিজেপির গাজিয়াবাদের শহর-সভাপতি অজয় শর্মা। অভিযোগ, ‘লাভ জিহাদ’ চলবে না। জোধা আকবর থেকে হাদিয়া- এ ইতিহাস বদলাতে হবে। এরপর টায়ার জ্বালিয়ে শুরু হয় রাস্তা অবরোধ। তারপর যুবকটির বাড়ির সামনে বিক্ষোভ। পুলিশের লাঠিচার্জ।

মেয়ের বাবা পুষ্পেন্দ্র সিঙ্ঘল গতকাল কবিনগর থানায় এফআইআর করেছেন। এখন পাড়া শান্ত। তবুও মনসুর বললেন, ‘আজও বিজেপি কর্মীরা বাড়ি এসে বলে গিয়েছে, পুলিশকে দিয়ে ধর্ষণের মামলা করিয়ে দেব। পুলিশও খবরের কাগজের কাছে কথা বলতে বারণ করেছে।’ পুষ্পেন্দ্র অবশ্য রুখে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘কীসের ভয়?’

প্রথমে প্রেম। তারপর দুই পরিবারের কথাবার্তা। দুই পরিবারের সম্মতি নিয়েই বিয়ে। ১৯৫৪ সালের বিশেষ বিবাহ আইন অনুসারে মুসলিম ছেলেটি স্থানীয় বিবাহ রেজিস্ট্রারের কাছে বিয়ের অনুমতি চেয়েছিলেন। দুই পরিবারের লিখিত সম্মতি জানানো হয়েছে এক মাস আগেই। আইন অনুসারে সরকার কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে, কারও কোনও আপত্তি আছে কিনা? কেউ আপত্তি জানাননি। অথচ এখন এই ধুন্ধুমার!

গাজিয়াবাদের দূরত্ব দিল্লি থেকে ৪০ কিলোমিটার। মোগল সম্রাটদের বনভোজনের জায়গায় এখন শপিং মল, ঝাঁ-চকচকে রিয়েল এস্টেট। এলাকার সাংসদ বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল ভি কে সিংহ। হিন্দু জনসংখ্যা ৮০%, মুসলমান প্রায় ১৫%। খ্রিস্টানও আছেন। এ এলাকায় কমপক্ষে ১০টি ছোট-বড় গির্জায় শুরু হয়ে গেছে বড়দিনের উৎসব। কবিনগরের কাছেই আছে জামা মসজিদ।

কাকতালীয়, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ আজ গায়ে-লাগানো শহর নয়ডায়। তিনি কোনও মন্তব্য করেননি। দিল্লিতে বিজেপি মুখপাত্ররা লালুপ্রসাদকে নিয়ে ব্যস্ত। কেউ কেউ ঠোঁট উল্টে বলেছেন, এমন হয়েছে- সত্যি নাকি? এদিকে কেউ গ্রেফতার হল না। পুষ্পেন্দ্রের প্রশ্ন, বিজেপির শহর-সভাপতি গ্রেফতার হবেন না কেন?

স্থানীয় পুলিশ সুপার অশোক তোমর বললেন, ‘দু’জনের বাড়ির বাইরে পুলিশ মোতায়েন করেছি। আজ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।’ পুলিশ পাত্রীপক্ষের সঙ্গে বজরং দলের নেতাদের বৈঠক করিয়েছে। বিশেষ লাভ হয়নি। যত বলা হয়েছে এ তো দুটো পরিবারের ব্যক্তিগত ব্যাপার, হিন্দুত্ব বাহিনী বলেছে- না, এ হল রাষ্ট্রবিরোধিতা।

দিল্লি থেকে নয়ডা মেট্রো রেল চালু করতে প্রধানমন্ত্রী এ এলাকায় আসছেন বড়দিনে। সেদিন অটলবিহারী বাজপেয়ীর জন্মদিনও বটে। গুজরাত দাঙ্গার পরে যিনি নরেন্দ্র মোদিকে রাজধর্ম পালনের পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, শাসকের কাছে জাতিধর্মের ভেদ হয় না। তবে নুপূর সিঙ্ঘলের বিয়ে নিয়ে কী বলবেন তিনি?

আজকের বাজার: আরআর/ ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭