ভয়াল সেই কালরাত আজ

আজ ২৫ মার্চ, গণহত্যা দিবস। ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার ভয়াল স্মৃতির কাল রাত। ১৯৭১ সালের এই তারিখে, রাতে এ দেশের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর হামলা শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত হত্যাযজ্ঞের দিন। যে হত্যাযজ্ঞের নাম ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসা এক বিভীষিকাময় ভয়াল কাল রাত।।

বাঙালি যখন স্বাধীনতার নেশায় উন্মুখ, মুক্তিরআকাঙ্ক্ষা যখন বাঙালির হৃদয়েরএকমাত্র চাওয়া, তখনই হিংস্র দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক বাহিনী। এরপর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার সর্বস্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো৯ মাস ধরে চলে সেই হত্যাযজ্ঞ। অার সে যুদ্ধে প্রাণ হরায় প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। একই সঙ্গে সম্ভ্রমহানী হয় ২ লাখ মা-বোনের। ৩০ লাখ শহিদ আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভমের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। বাঙালি পায় লাল সবুজের এক টুকরো বাংলাদেশ। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

গত বছর থেকে এই দিনটি পালন হচ্ছে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে। গত বছরের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে এ প্রস্তাব পাস হবার পর ২০ মার্চ মন্ত্রী সভার বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়।

কর্মসূচি

‘গণহত্যা দিবস’ উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনও নানা আয়োজনের মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করবে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সভা, সমাবেশ, র‌্যালি, প্রদীপ প্রজ্বলন, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোকচিত্র, তথ্যচিত্র ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীসহ নানা কর্মসূচি।

কালোরাতের প্রথম প্রহর স্মরণ করে গণহত্যা দিবসে আজ রাতে এক মিনিট অন্ধকারে (ব্ল্যাক-আউট) থাকবে সারা দেশ। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার স্মরণে রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশ অন্ধকার থাকবে। গত ১১ই মার্চ সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

এদিকে গণহত্যা দিবসে এক মিনিট বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখাসহ সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

চিঠিতে জানানো হয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, তথ্য মন্ত্রণালয়, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর এবং সব জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) মাধ্যমে গণহত্যা দিবসে এক মিনিট ব্ল্যাক আউট কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।

এছাড়াও জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালনের অংশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় আজ সকাল ১০টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘রক্তাক্ত ২৫ মার্চ গণহত্যার ইতিহাস’ শীর্ষক শিরোনামে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।

২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ এদিন বিকেল ৪টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এতে সভাপতিত্ব করবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির যৌথ উদ্যোগে ‘গণহত্যা দিবস’ পালন করা হবে। এ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে আয়োজন করা হয়েছে নানা অনুষ্ঠানের।

অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে : সন্ধ্যা ৭টায় স্মৃতি চিরন্তন-এ মোমবাতি প্রজ্বলন, ডকুমেন্টারি প্রদর্শন আলোচনা সভা। এছাড়া, বা’দ জোহর মসজিদুল জামিয়ায় ২৫ মার্চের রাতে নিহতদের স্মরণে বিশেষ মোনাজাত এবং বিশ^বিদ্যালয় এলাকার অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে অনুষ্ঠিত হবে প্রার্থনা সভা। রাত ৯টা থেকে ৯টা ১মিনিট পর্যন্ত ২৫ মার্চ কালরাত স্মরণে জরুরি স্থাপনা ব্যতিত সকল জায়গায় “ব্লাক-আউট” কর্মসূচি পালন করা হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলও এ উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে : ২৫ মার্চ কালরাতে নিহত শহীদদের স্মরণে জগন্নাথ হল পরিবারের পক্ষ থেকে হল প্রাঙ্গণে স্মরণ অনুষ্ঠান। স্মরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।

অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে : বিকেল ৪টা ১ মিনিটে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, সন্ধ্যা ৬টা ১ মিনিটেশহীদদের স্মরণে স্থাপনা শিল্পের প্রদর্শন (ইনস্টলেশনআর্ট), দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা আবৃত্তি, নাটক (কালরাত্রি), রাত ৯.০১ মিনিটে-ব্ল্যাকআউট এবং গণসমাধিতে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ইত্যাদি।

রোকেয়া হলের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে রোকেয়া হলের অভ্যন্তরে যেসকল নারী ও কর্মচারীবৃন্দ পাকিস্তানী সামারিক বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়েছিলেন সেসকল বীর নারী ও শহীদ কর্মচারীদের স্মরণে প্রথমবারের মত রাত ৮টায় রোকেয়া হল পরিবার এক স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ ২৫ মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আলোক প্রজ্জ্বলন কর্মসূচির আয়োজন করেছে। দলটির সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এতে যোগ দেবেন। বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল যৌথভাবে গণহত্যা দিবস স্মরণে আগামীকাল সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে পুরানা পল্টনের মুক্তিভবন থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তন পর্যন্ত আলোর মিছিলের আয়োজন করেছে।

গত বছরের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হওয়ার পর থেকেই দিনটি জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।

১৯৭১ সালের এইদিনে বাঙালী জাতির জীবনে এক বিভিষিকাময় রাত নেমে আসে। মধ্য রাতে বর্বর পাকিস্তানি হানানদার বাহিনী কাপুরুষের মত তাদের পূর্ব পরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকসা অনুযায়ী আন্দোলনরত বাঙালীদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আরএম/