লভ্যাংশ প্রদানে শীর্ষে টেলিযোগাযোগ খাত

পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো ও মিউচুয়াল ইউনিটসহ ১৯ খাত রয়েছে। এর মধ্যে শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশ প্রদানের শীর্ষে রয়েছে টেলিযোগাযোগ খাত।

দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাত। এরপরে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের অবস্থান। অন্যদিকে শেয়ারহোল্ডারদের সবচেয়ে কম লভ্যাংশ দেয় পেপার ও প্রিন্টিং খাত। রাষ্ট্রায়ত্ত সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুন ২০১৭ শেষ হওয়া বছরে টেলিকম খাত গড়ে মোট ১৫৭ দশমিক শূন্য চার শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে, যা আগের বছর (জুন, ২০১৬) ছিল ১২৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) এ খাতের দুটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত। কোম্পানি দুটি হচ্ছেÑগ্রামীণফোন লিমিটেড ও বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্ল কোম্পানি লিমিটেড। এর মধ্যে গ্রামীণফোন বহুজাতিক কোম্পানি। মোট বাজার মূলধনের প্রায় ১৫ শতাংশই এ কোম্পানিটির দখলে।

সর্বোচ্চ লভ্যাংশ প্রদানের হিসাবে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাত। এ খাতের কোম্পানিগুলো জুন ২০১৭ হিসাববছরে মোট ৬২ দশমিক ৬৪ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে, যা এর আগের হিসাববছরে (জুন ২০১৬) ছিল ৫৯ দশমিক শূন্য চার শতাংশ। ডিএসইতে খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতে মোট ১৮টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড একমাত্র বহুজাতিক কোম্পানি।

শেয়ারহোল্ডারদের সর্বোচ্চ লভ্যাংশ প্রদানে তৃতীয় স্থানে রয়েছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত। এ খাতের ১৮টি কোম্পানি গত হিসাববছরে ৩৭ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। আগের বছর ছিল ২৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ। জুন ২০১৫ হিসাববছরে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের লভ্যাংশের পরিমাণ ছিল ২৭ দশমিক শূন্য আট শতাংশ।

জুন ২০১৭ হিসাববছরে ট্যানারি খাত গড়ে ৩৬ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ লভ্যাংশ দেয়। ওষুধ ও রসায়ন খাত শেয়ারহোল্ডারদের ২৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ লভ্যাংশ। সিমেন্ট খাতের লভ্যাংশের পরিমাণ ২২ দশমিক ৬০ শতাংশ। ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে আর্থিক খাত। প্রকৌশল খাতের কোম্পানিগুলো মোট ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ শেয়ারহোল্ডারদের দেয়। সিরামিক ও বিমা খাতের যথাক্রমে ১১ দশমিক ২৮ এবং ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ।

এদিকে ব্যাংক খাতের লভ্যাংশ দেওয়ার পরিমাণ ১০ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এরপরেই বিবিধ খাতের অবস্থান। এ খাতের কোম্পানিগুলো সমন্বিতভাবে আট দশমিক ৫১ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। ভ্রমণ ও অবকাশ খাত ছয় দশমিক ৪০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে শেয়ারহোল্ডারদের। জুট ও বস্ত্র খাতের এ হার যথাক্রমে পাঁচ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং পাঁচ দশমিক ৫০ শতাংশ। তথ্য ও প্রযুক্তি খাত পাঁচ দশমিক ২৬ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। সেবা ও আবাসন খাতের লভ্যাংশের পরিমাণ চার দশমিক ৭৯ শতাংশ। মিউচুয়াল ফান্ডগুলো গড়ে তিন দশমিক ১৯ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়। খাতভিত্তিক হিসাবে সবচেয়ে কম লভ্যংশ দেয় পেপার ও প্রিন্টিং খাত। এ খাত গড়ে এক দশমিক শূন্য তিন শতাংশ লভাংশ দেয় বলে আইসিবির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

কোনো কোম্পানির তার মুনাফার যে অংশ শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণ করে তা-ই লভ্যাংশ বা ডিভিডেন্ড। কখনও কখনও রিজার্ভ বা সংরক্ষিত তহবিল থেকেও লভ্যাংশ বিতরণ করা হয়। লভ্যাংশ নগদ টাকা ও স্টক বা বোনাস (শেয়ার) অথবা উভয় আকারে হতে পারে। ২০১৭ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানির নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার পরিমাণ কমছে বলে ডিএসই সূত্রে জানা গেছে।

ডিএসইর তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ২৯১টি কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) অনুষ্ঠিত হয় এবং এর মধ্যে ১৮৫টি কোম্পানি দুই শতাংশ থেকে ৭৭৫ শতাংশ পর্যন্ত নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর আগের বছর ১৯১টি কোম্পানি তিন শতাংশ থেকে ৬৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে।

এদিকে ২০১৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ১৪২টি কোম্পানি বোনাস শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মূলধন বৃদ্ধি করেছে, যার পরিমাণ দুই হাজার ৮০৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। আর এর জন্য কোম্পানিগুলোকে ২৭৯ কোটি ২৯ লাখ বোনাস শেয়ার ইস্যু করতে হয়েছে।

ডিএসইর তথ্যমতে, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ব্যাংক খাতের ১৭টি, আর্থিক খাতের ১০টি, প্রকৌশল খাতের ২২টি, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের পাঁচটি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের পাঁচটি, পাট খাতের একটি, বস্ত্র খাতের ২৪টি, ওষুধ ও রসায়ন খাতের ১২টি, সেবা ও আবাসন খাতের দুটি, সিমেন্ট খাতের একটি, আইটি খাতের চারটি, ট্যানারি খাতের দুটি, সিরামিক খাতের তিনটি, বিমা খাতের ২৫টি এবং বিবিধ খাতের সাতটি কোম্পানি রয়েছে।

২০১৬ সালে মোট ১২৬টি কোম্পানি শেয়ারবাজারে বোনাস শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মূলধন বাড়িয়েছিল। এ বছরে দুই হাজার ৫০৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা মূলধন বৃদ্ধি করে। এর জন্য ২৫০ কোটি ৮০ লাখ বোনাস শেয়ার ইস্যু করতে হয়। সেই হিসাবে গত বছরের তুলনায় ১৬ কোম্পানি নতুন যুক্ত হয়েছে বোনাস শেয়ার ইস্যু করার তালিকায়। তাতে মূলধন বেড়েছে ২৯৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

সিকিউরিটিজ আইনের বিধান অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি ১০ শতাংশের কম ও পাঁচ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ দিলে ‘এ’ থেকে ‘বি’ ক্যাটেগরিতে লেনদেন হয়। যদি পাঁচ শতাংশেরও কম কোনো ধরনের লভ্যাংশ প্রদান করে তাহলে স্টক এক্সচেঞ্জের ‘জেড’ ক্যাটেগরিতে কোম্পানিটির লেনদেন পরিচালিত হয়।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর স্টক (বোনাস) লভ্যাংশ দেওয়ায় বিনিয়োগকারীরা সাময়িকভাবে উপকৃত হলেও দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আর এতে উদ্যোক্তা-পরিচালকরা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।

এছাড়া বোনাস লভ্যাংশের কারণে প্রতিবছরই শেয়ারের পরিমাণ বাড়লেও কোম্পানির মুনাফা আনুপাতিক হারে বাড়ছে না। এতে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) কমার পাশাপাশি কমছে ডিভিডেন্ডের পরিমাণ। ফলে শেয়ারদরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ইপিএস কমায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও একসময় শেয়ারে অনাগ্রহ দেখায়। এতে কখনও কখনও শেয়ারদরে ভাটা পড়ে।

তারা বলছেন, একটি কোম্পানি যখন ব্যবসা সম্প্রসারণ ছাড়াই শুধু বোনাস ডিভিডেন্ড দিতে থাকে তখন সেগুলোয় বিনিয়োগ না করাই ভালো। তার ওপর যদি পরিচালকদের বোনাস বিক্রির ঘোষণা থাকে তাহলে তো কোম্পানির শেয়ারে আরও নেতিবাচক অবস্থা সৃষ্টি হয়। শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ দেওয়া ভালো। তবে স্বাভাবিকভাবেই বেশি লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডাররা ইতিবাচক হিসেবে দেখেন। তবে বেশি নগদ লভ্যাংশ দিলে পরবর্তী সময়ে বেশি আয় করা সম্ভব হয় না। কোম্পানিকে দীর্ঘ মেয়াদে সুসংহত করতে লভ্যাংশ প্রদানে মাঝামাঝি পন্থা অবলম্বন করাই মঙ্গলজনক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার হার বাড়লে এটা সার্বিক বাজার পরিস্থিতির জন্য ভালো। নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার মানে হলো কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বাড়ছে, তাদের আয়ও হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, বোনাস লভ্যাংশ দেওয়ার প্রধান কারণ হলো কোম্পানির ব্যবসা সম্প্রসারণ করা। এটা সারা বিশ্বে প্রচলিত। কিন্তু আমাদের দেশে বোনাস লভ্যাংশ দেওয়ার অর্থ হলো বেশিরভাগ কোম্পানির নগদ দেওয়ার ক্ষমতা নেই। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। একপর্যায়ে শেয়ারের দর পড়ে যায়।