সরকারের শেষ বছর

শিক্ষা খাতে অসন্তোষ চরমে

রাসেল মাহমুদ : বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের ক্ষমতার শেষ বছরে এসে দেশের শিক্ষা খাতে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে এই অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এর মূলে রয়েছে বেতন বৈষম্য ও মর্যাদা। পাশাপাশি এমপিও ভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণকে কেন্দ্র করেও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে গত কয়েক মাস ধরেই শিক্ষা খাত জুড়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
খোঁজ নিয়ে যানা যায়, অতিমাত্রায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও বহুমাত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠার কারণে শিক্ষকদের মধ্যে নানা ধরনের স্তর ও বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী শিক্ষকদের মর্যাদাও দেওয়া হচ্ছেনা বলে দাবি শিক্ষকদের।
সারাদেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কারিগরি ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের সংগঠন রয়েছে প্রায় ২৬টি। এসব সংগঠনের সদস্য প্রায় ৯ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী। এ সব সংগঠনের শিক্ষকরা গত বছরের শেষ দিক থেকে বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। এখন পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। ফলে অসন্তোষ থেকে মুক্ত হচ্ছেনা শিক্ষা খাত।
এ দিকে শিক্ষকদের এই অসন্তোষ দেশের শিক্ষার জন্য বড় হুমকি বলে মনে করেন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক পরিচালক মো. একরামুল করিম। এর আগে তিনি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, শিক্ষকদের আন্দোলনের ফলে শিক্ষা ব্যবস্থা বড় ধরনের হুমকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা আর বহুমাত্রিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পাওয়ায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে শিক্ষকরা যোগ্যতা ও ডিগ্রির ভিত্তিতে সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন না। প্রতিষ্ঠাতারা প্রতিষ্ঠান থেকে নানাভাবে বাণিজ্য করে যাচ্ছেন।

যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অসন্তোষ রয়েছে
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে গ্রেড বৈষম্য নিয়ে অনেক দিন ধরেই অসন্তোষ রয়েছে। এই বৈষম্য নিরসরে দাবিতে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে আমরণ অনশনও করেন শিক্ষকরা। এই বৈষম্য দূর করা হবে মর্মে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মুস্তাফিজুর রহমান ফিজার আশ^াস দিলে আন্দোলন স্থগিত করেন তারা।
এ সব শিক্ষকরা জানায়, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকদেও বেতন, সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদার দিক থেকে বড় ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। সহকারী শিক্ষকদের আগের পদ প্রধান শিক্ষক হলেও তিন ধাপে পার্থক্য তৈরি হয়েছে। প্রধান শিক্ষকরা দশম গ্রেড পেলে এ বৈষম্য আরও বাড়বে। এ কারণে প্রথমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষকরা এক জোট হয়ে রাজধানীর শহিদ মিনারে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলেন।

এমপিওভুক্তির দাবি
প্রাথমিক শিক্ষকরা আন্দোলন ছেড়ে ক্লাসে ফিরলেও দেশের নন-এমপিও স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীরা রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এমপিওভুক্তির দাবিতে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন। এরপর তারা আমরণ অনশনের ডাক দেন। টানা ছয়দিন আমরণ অনশন পালনের পর প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে এসব শিক্ষক বাড়ি ফিরে যান। শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দ্রুতই শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি করা না হলে তারা আবারও আন্দোলনে নামবেন। সারাদেশে নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫ হাজার ২৪২টি। এগুলোতে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ৭৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার।
জানা গেছে, সর্বশেষ ২০১০ সালে ১ হাজার ৬২৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। এরপর থেকে এমপিওভুক্তি বন্ধ রয়েছে।
জাতীয়করণের দাবি
গত ১ জানুয়ারি থেকে জাতীয়করণের দাবিতে শুরু হয় স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষকদের আন্দোলন। টানা নয় দিন অবস্থান ধর্মঘট পালনের পর আট দিন আমরণ অনশন পালন করেন। শিক্ষামন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলীর প্রতিনিধি হিসেবে এই মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সোহবার হোসেন শিক্ষকদের দাবির বিষয়টি বিশেষভাবে দেখা হবে বলে আশ্বাস দিলে অনশন ভাঙেন শিক্ষকরা।
অন্যদিকে, দেশে মাধ্যমিক থেকে কলেজ পর্যন্ত ৯৭ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় বেসরকারিভাবে। বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ৩৭ হাজার। এগুলোতে শিক্ষক-কর্মচারী প্রায় ৫ লাখ। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে সাড়ে ২৬ হাজার। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৪ লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে। জাতীয়করণের দাবিতে গত ১০ জানুয়ারি থেকে এসব শিক্ষক-কর্মচারীরাও রাজপথে নামেন। প্রথমে অবস্থান ধর্মঘট, পরে আমরণ অনশন করেন তারা। এরপর সরকারের আশ^াসে আন্দোলন প্রত্যাহার করেন তারা। এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের ছয়টি সংগঠন জোট হয়ে বেসরকারি শিক্ষা লিয়াঁজো ফোরামের নেতৃত্বে এ আন্দোলন করে।

সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের দাবি
টাইম স্কেল ও পদোন্নতির দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির ব্যানারে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন তারা। সারাদেশে ৩৩৬টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১০ হাজার শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও আছেন প্রায় ৮ হাজার। শিক্ষকদের দাবি আদায়ে তারা নতুনভাবে আন্দোলনের প্রস্তুতিত নিচ্ছেন বলেও জানা গেছে।
কলেজ শিক্ষকদের ক্যাডার ও নন-ক্যাডার আন্দোলন
দেশে ৩৩৫টি সরকারি কলেজ আছে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেসব উপজেলায় সরকারি কলেজ নেই সেখানে একটি করে বেসরকারি কলেজকে সরকারি করা হবে। নতুন করে আরও ২৮৩টি বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণের জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছে। কিন্তু আগে থেকে নীতিমালা ছাড়াই এতগুলো বেসরকারি কলেজকে জাতীয়করণ করায় সংকট তৈরি হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ঘোষিত মানদ- না থাকায় ভালো ও পুরনো কলেজ বাদ দিয়ে যেন-তেন কিছু কলেজ জাতীয়করণের জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছে। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনও হয়েছে।
বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের দাবি
বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আন্দোলন শুরু কওে গত ২১ জানুয়ারি। এ আন্দোলনের শুরুতে অবস্থান ধর্মঘট করলেও গত ৯ দিন হলে তারা আমরণ অনশন করছেন। তাদের দাবি সকল প্রকার শর্ত পূরণ করার পরও জাতীয়করণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে দেশের ৪ হাজার ১৫৯টি স্কুল।
বাংলাদেশ বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. মামুনুর রশিদ খোকন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি এক ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের ২৬ হাজার ১শ ৯৩ টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। কিন্তু জাতীয়করণের জন্য যে সব শর্ত রয়েছে তা আমরা পূরণ করার পরও প্রায় ৪ হাজার ১৫৯টি বিদ্যালয় জাতীয়করণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
আজকের বাজার : আরএম/সালি, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮