এলপি গ্যাস সিলিন্ডার কতটা নিরাপদ

নাজমুল লিখন: গ্যাস স্বল্পতার কারণে আবাসিক খাতে পাইপলাইনের পরিবর্তে এলপি গ্যাস ব্যবহারের পথে হাঁটছে সরকার। ফলে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারের পরিমান দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিরাপত্তার দিকগুলো গুরুত্ব পাচ্ছে না। এতে দুর্ঘটনার শঙ্কা বাড়ছে।
এলপি গ্যাস বিক্রির ডিলার কিংবা ব্যবহারকারীরদের অনেকেই সিলিন্ডারের ভালো-মন্দ বুঝতে পারেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমন সুযোগও থাকেনা গ্রাহকদের। পাশাপাশি গ্রাহকের বাসায় চুলাসহ যে স্থাপনা তৈরি করতে হয়, তাতে ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মানও অধিকাংশ ক্ষেত্রে খারাপ। এছাড়া মাঠপর্যায়ে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদেরও তদারকির অভাব রয়েছে। ফলে ‘গ্যাস লিক’ হওয়া, বিস্ফোরন হয়ে আগুন ধরে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে।
সর্বশেষ গত ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামের রাঙুনিয়া উপজেলায় গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির দোকানে বিস্ফোরণের ঘটনায় এক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এর এক মাস আগে ২৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর কুসুমবাগ এলাকার একটি বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ হন মা ও দুই সন্তান। এরকম ঘটনা মাঝেধ্যেই ঘটছে। এসব দূর্ঘটনায় হতাহতের পাশাপাশি বিপুল আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম তামিম বলেন, এলপিজির মার্কেট দিন দিন বড় হচ্ছে। বর্তমানে ৬ লাখ টনের মার্কেট রয়েছে। সামনে এ মার্কেট আরও অনেক বড় হবে। সুতরাং অবশ্যই এটার জন্য আলাদা একটা রেগুলেটরী বডি দরকার। কারণ আনরেগুলেড মার্কেটে নানারকম প্লেয়ার আছে। এতে নিরাপত্তা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। দামও নিয়ন্ত্রনে নেই। এজন্য দ্রুত রেগুলেড বডি তৈরি করতে হবে যারা দাম থেকে শুরু করে নিরাপত্তা, সচেতনতা বৃদ্ধি ও অন্যান্য বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে দেখভাল করবে। পাশাপাশি ব্যবহারকারীকেও সচেতন হওয়া জরুরী।
২০১৬ সালের আগস্টে বিপিসির বগুড়া ডিপোতে পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ৩০০ সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর এ নিয়ে নিরাপত্তার বিষয়টি বেশি আলোচিত হয়। তখন পরীক্ষার পর বিপিসির ১১ হাজার গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষা করে সেগুলোর মধ্য থেকে আট হাজার সিলিন্ডার বাতিল করা হয়।
রান্নার কাজে যারা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করেন, তাদের অনেকেই সিলিন্ডারের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। আবার গ্যাস চালিত গণপরিবহনে চলাচলকারী যাত্রীদের মধ্যেও এক ধরনের উদ্বেগ কাজ করে। কর্তৃপক্ষ বলছে এ উদ্বেগ দূর করতেই সিলিন্ডার পরীক্ষার কাজ করা হচ্ছে।
বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রধান পরিদর্শক মো.সামসুল আলম বলেন, নিয়ম মেনে রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে প্রতিটি সিলিন্ডার ৪০ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু দেশে সিলিন্ডারগুলো পরিবহন পর্যায়ে বিশেষ করে ডিলার পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তিনি জানান, ১০ বছর পরপর বিস্ফোরক অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে সিলিন্ডার রি-টেস্ট (পরীক্ষণ) করাতে হয়। এতে উত্তীর্ণ হলে প্রতিটি সিলিন্ডার পরবর্তী ১০ বছর পর্যন্ত ব্যবহারের অনুমোদন পায় উত্পাদন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো।
বিস্ফোরক আইন অনুযায়ী ১০ টির বেশি গ্যাসপূর্ণ সিলিন্ডার মজুদের ক্ষেত্রে লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক। এলপি গ্যাস সংরক্ষণের জন্য বিশেষ নকশা মেনে গুদামঘর তৈরি করতে হয়। পাশাপাশি সেখানে আগুন নেভানোর জন্য অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম মজুদ রাখতে হবে। এ আইন অমান্য করলে অন্যূন দুই বছর এবং অনধিক পাঁচ বছরের জেল এবং অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাস পর্যন্ত কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ম না মেনে প্রয়োজনীয় লাইসেন্স ছাড়াই এলপি গ্যাস বিক্রি করছেন। এছাড়া পরিবহনের সময়ও সিলিন্ডারের সুরক্ষার জন্য তেমন কোন নজর দেওয়া হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রধান পরিদর্শক মো.সামসুল আলম বলেন, প্রয়োজনীয় সনদ ছাড়া এলপি গ্যাস বিক্রি করা জননিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এজন্য স্থানীয় জেলা প্রশাসক এবং থানা নির্বাহী কর্মকর্তাদেরকে এ ব্যাপারে নিয়মিত তদারকি জোরদার করতে বলা হয়েছে।
এলপি গ্যাসের কয়েকজন খুচরা বিক্রেতা জানান, লাইসেন্সের ব্যাপারটি কেউ সেভাবে খতিয়ে দেখে না, তাই টাকা খরচ করে তারা এটি নিতে আগ্রহবোধ করেন না।
প্রায় ৪ বছর ধরে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করেন চুয়াডাঙ্গার বাসিন্দা চামেলী হক। তিনি বলছিলেন, ‘সাবধানতার সাথেই এই গ্যাস ব্যাবহার করে আসছি। তারপরও বিভিন্ন সময় যখন গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরনের খবর পায় তখন কিছুটা ভয় কাজ করে।’
ঢাকার উত্তরখান এলাকার মোজাম্মেল হক বলছিলেন, গ্যাস শেষ হওয়ার পর যখনই সিলিন্ডার কিনতে যাই তখনই ্এক ধরনের টেনশন কাজ করে। কারণ সিলিন্ডার বিস্ফোরণে অনেক ঘটনা হয়েছে। কিন্তু উপায় তো নেই। সিলিন্ডারের চাহিদা দিনদিন বাড়ছে তাই এখনই এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুবই জরুরী বলে মনে করেন তিনি।
সূত্রমতে, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের জনবলের অভাবে নিয়মিত বিরতিতে সিলিন্ডারগুলো পরীক্ষার কোনো উদ্যোগ তাঁরা সাধারণত নিতে পারেন না। আবাসিক কিংবা যানবাহনে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষার জন্য তাদের তালিকাভুক্ত বেশ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্টান রয়েছে। সেখান থেকেই মূলত এসব সিলিন্ডার পরীক্ষা করে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। সারাদেশে এধরনের প্রতিষ্টানের সংখ্যা মাত্র ২৭ টি। তাও আবার মাত্র ১০ জেলায় এই সুযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে কেবল চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও কৈলাসটিলায় বিপিসির সিলিন্ডার পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। এর বাইরে সিলিন্ডার পরীক্ষার সরকারি তেমন কোন পরীক্ষাগার নেই।

আজকের বাজার : এনএল/সালি, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮