১৯৭১-এর ২৫ এপ্রিল বরিশালের চরবাড়িয়ায় পাক-বাহিনী চালায় পৈশাচিক বর্বরতা

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৯৭১-এর ২৫ এপ্রিল জেলার সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নে পৈশাচিক বর্বরতার মাধ্যমে গণ-হত্যাযজ্ঞ চালায় পাক-হানাদার বাহিনী।

স্থানীয়রা জানায়, গণহত্যায় দুই বছরের শিশু থেকে ৯০ বছরের বৃদ্ধকেও নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল সেদিন। গুলিতে আহত হয়েছেন অনেকে, পরবর্তীতে এদের মধ্যে অনেকেই কর্ম ক্ষমতা হারিয়ে ও বিভিন্ন রোগে ভুগে মৃত্যুবরণ করেছেন। একই দিন পাক বাহিনী সড়ক পথ ও জলপথ একযোগে বরিশালে আক্রমন চালায়। যদিও তার ঠিক এক সপ্তাহ আগে আকাশ পথ দিয়ে বর্তমান বরিশাল নগরীতে পাক বাহিনী ব্যাপক বোমা ও গুলিবর্ষণ করলেও তারা নগরীতে নামেনি। পাক বাহিনীর ধারণা ছিল, ব্যাপক সংখ্যাক বীর মুক্তিযোদ্ধা বরিশালে ঘাঁটি গেড়ে বসেছেন।

এ বিষয়ে তৎকালীন শহর ছাত্রলীগের সভাপতি বীর-মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত হোসেন চৌধুরী, বিভাগীয় সেক্টর কমান্ডার ফোরামের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রদীপ কুমার ঘোষ পুতুল ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরে আলম ফরিদ জানায়, ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল সড়ক পথে ফরিদপুর শহর পতনের পর পাক বাহিনীর বিশাল একটি ট্রুপ বরিশালের দিকে রওয়ানা দেয়। ভুরঘাটায় এ ট্রুপ ব্যাপক বাঁধার সম্মুখীন হয়। গৌরনদী উপজেলার কটকস্থলে মুক্তি বাহিনীর একাংশ বাধা দিলে এখানে ৫ মুক্তি বাহিনী সদস্য ও বেশকিছু পাক আর্মি হতাহত হয়। এরপরেও পাক আর্মি সড়ক পথে বরিশালে পৌঁছায়। জলপথে পাক আর্মি গানবোট জুনাহারে নদীতে পৌঁছানোর পাশাপাশি দুটি হেলিকপ্টার থেকে পাক আর্মি প্যারাট্রুপার নামিয়ে দেয়। তালতলি ও জুনাহারে ব্যাপক সংখ্যক পাক আর্মি সশস্ত্র অবস্থায় কভারিং করে।

অপরদিকে, পাক আর্মির গানবোট কীর্তনখোলা নদী তীরবর্তী স্থানে ফায়ার করতে থাকে। নদী পথে পাক আর্মি প্রতিহত করার জন্য চরবাড়িয়ায় মহাবাজ উচ্চ বিদ্যালয়ে মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়। ঝুনাহার নদীর সংযোগে ইরানী ও মাজভী নামে দুটি স্টিমার নোঙর করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা আড়াল করে পজিশন সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে। গান বোটগুলো যখন ঝুনাহার ও তালতলি অতিক্রম করেছিল তখন শায়েস্তাবাদ ও চরবাড়িয়া থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুড়লে পাক গান বোট থেকে শেল বর্ষিত হতে থাকে। ‘ইরানী ও মাজভী’ এর ফলে ডুবে যায়। সেইদিন চরবাড়িয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান হারান তার স্বজন। পাকিস্তান আর্মিদের গুলিতে শহীদ হন আবদুল মান্নানের স্বজন আবদুর রহমান খান ও আলী আজিম খান।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা আরো জানায়, এটি ছিল বরিশাল অঞ্চলে পাকিস্থানী বাহিনীর প্রথম গণহত্যা। এরপরে পাকিস্থান আর্মি বরিশাল শহরের ওয়াপদায় তাদের সামরিক স্থাপনা গড়ে তোলে এবং বরিশাল জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে গণহত্যা চালিয়ে। ঔইদিন পাকিস্তান আর্মিদের গুলিতে শহীদ হন আমার পিতা আবদুর রহমান খান ও দাদা আলী আজিম খান।

এ প্রসঙ্গে আলাপকালে চরবাড়িয়া ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আবদুল মান্নান বলেন, ২৫ এপ্রিল সকাল ১০টা থেকে ১১টা হবে। সকাল থেকে দু’টি হেলিকপ্টার থেকে ছত্রী সেনা নামতে ছিল চরবাড়িয়াসহ বিভিন্নস্থানে, অন্যদিকে পাকিস্তানি গান বোটগুলোও বরিশালের দিকে আসতে ছিল। তবে জুনাহারে আসলে তারা বাঁধা পায়, কেননা অন্য দু’টি জাহাজ দিয়ে আড়াআড়ি বাঁধা দেয়া হচ্ছিল। এমন সময় আগে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ সেখানে অবস্থান করছিল।

মুক্তিযোদ্ধারা ফায়ার করলে গান বোট দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকে পাকিস্তানি আর্মিরাও। এক পর্যায়ে তারা তালতলীতে নেমে ঘরে-ঘরে আগুন দিয়ে গুলি করতে থাকে। পরের দিন তারা চরমোনাই ইউনিয়নের কায়েকটি ঘরে আগুন দেয় ও গুলিবর্ষণ করে বরিশালের দিকে চলে যায়। বরিশাল ঘাটে পাক-বাহিনীর সদস্যদের বেশ কিছু স্বাধীনতা বিরোধী লোকজন স্বাগত জানায়। ২৫ এপ্রিল পুরো চরবাড়িয়া এলাকায় চলে পাক-বাহিনীর পৈশাচিক বর্বরতা। তারা যাত্রা পথে যাদের পেয়েছে তাদেরই হত্যা করেছে। মসজিদের ইমাম, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধা, মায়ের কোলের শিশুসহ বহু মানুষকে হত্যা করে তারা। এভাবে অনেককেই হত্যা করা হয় ওইদিন। আবার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান নেয়ার খবর পেয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় সাপানিয়ায় প্রাচীর ঘেরা বাড়িটি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান বলেন, বীর চিরন্তন ছাড়া তালতলী বাজার সংলগ্ন নিহতের স্মরণে একটি স্মৃতিস্থম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া আমি আমার বাবা শহীদ আবদুর রহমান স্মরণে একটি পাঠাগার নির্মাণ করেছি। তবে এখানে যে ৪৮ জন শহীদ হয়েছেন। পাকিস্তান আর্মিদের নির্বিচারে গুলিবর্ষণে বহু পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বরিশালের প্রথম নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় এ চরবাড়িয়া থেকে। এখানেই মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প, পরিখা এবং গণহত্যার নানান স্মৃতি রয়েছে।

যেগুলো সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি ১৯৭১’র অনেক জনপদ কীর্তনখোলার ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমান সরকার প্রধানের কাছে দাবি চরবাড়িয়ার রণাঙ্গনের ঝুনাহার পয়েন্টে (যেখানে দুটি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিলো পাক-হানাদার বাহিনী। এখানেই প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে) একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণের। খবর-বাসস

আজকের বাজার/আখনূর রহমান