২০১৭ : আলো আঁধারে আমাদের ফুটবল

বছর শেষ হতে বাকি আর মাত্র কিছু ঘণ্টা। নতুন বছরের আগমনী বার্তা ছড়িয়ে গেছে এখনই সবার মধ্যে। নতুনের কাছে মানুষের চাওয়াটা যে চিরন্তন। তাই পুরোনো বছরের দুঃখ ভুলে সবাই তাকাতে চাইবেন নতুন বছরের দিকে। কিন্তু নতুনের ভাবনার আবর্তন তো হবে পুরোনোকে কেন্দ্র করেই। ঠিক এই জায়গাটায় তাই পুরোনো বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিষয় গুরুত্ব নিয়েই থাকছে। ক্রীড়াঙ্গনের বিষয়টিও ঠিক তেমন। তা ২০১৭ সাল কেমন পার করলো বাংলাদেশের ফুটবল? পরিবর্তন ডট কম সেটিই তুলে ধরার চেষ্টা করেছে দুজন বিশেষজ্ঞের আলোচনার মধ্য দিয়ে। সাবেক ফুটবলার ও কোচ গোলাম সারোয়ার টিপু এবং সাবেক ফুটবলার ও বর্তমান কোচ শফিকুল ইসলাম মানিকের চোখে চলুন দেখে আসি ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ফুটবল।

গোলাম সারোয়ার টিপু
ফুটবল সম্পর্কে কিছু বলতে হলে তো এখন মেয়েদের নিয়েই যা একটু বলা যায়। সত্যি বলতে এখন ফুটবল বলতে বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবলকেই বোঝায়। ২০১৭ সাল নিয়ে কিছু বলতে বললে মেয়েদের সাফল্য নিয়ে গর্বই লাগে সত্যি। কিন্তু ছেলেদের ফুটবলে কোথাও কোন আলো তো দেখি না। আন্তর্জাতিক ফুটবল না খেলতে পারলে আমরা নিজেরা কোথায় আছি কিছু বোঝারও উপায় নেই। তাছাড়া ঢাকার লিগেও দেখা যাচ্ছে কোন খেলোয়াড়ই দর্শক আকৃষ্ট করতে পারছে না। পত্র-পত্রিকায় যা নিয়মিতই লেখা হয়। কাউকে বাংলাদেশের ক’জন ফুটবলারের নাম জিজ্ঞেস করুন। দেখবেন পাঁচ-ছয় জন মেয়ের নাম সবার মুখে মুখে ঘুরবে। কিন্তু ছেলেদের ফুটবলে পাঁচজন খেলোয়াড়ের নাম বলা যায় কি? এটাই সবচেয়ে হতাশার চিত্র। পুরুষ ফুটবলের অধঃপতনের পরম্পরাই যার জন্য দায়ী।

এছাড়া মফস্বলে কোন খেলা নেই। বাংলাদেশের ফুটবল বলতে কেউ যদি ঢাকার ফুটবলকেই বোঝাতে চায়, বোঝাতে পারে। কিন্তু এটা তো পুরো দেশের ফুটবল না। মেয়েদেরও সাফল্যের উল্টো পিঠ দেখলে একই চিত্র। মেয়েদের কোন ক্লাব নেইৃকিছুও তো নেই। চল্লিশ-পঞ্চাশ জন মেয়ে নিয়ে চলছে। তারপরও তারা আঞ্চলিক পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন তো হচ্ছে। হোক সেটা বয়সভিত্তিক ফুটবলে।
তবে ছেলেদের খেলাতেও এবার বয়স ভিত্তিক ফুটবলে (অনূর্ধ্ব-১৬ ও অনূর্ধ্ব-১৮) সাফল্য এসেছে। বয়সভিত্তিক ফুটবলে এ ধরনের সাফল্য আমাদের সব সময়ই ছিল। সেটার একটা কারণও আছে। যা আমি বলতে চাই না। বাংলাদেশর ফুটবলে বয়স চুরি নিয়ে নতুন করে তো বলার কিছু নেই। ২০১৫ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ। সেই ছেলেগুলো কই? সেই ছেলেদের না পরিচর্যার কথা ছিল? ২০১৬ সালের মতো ২০১৭ সালেও তো তাদের সঠিক পরিচর্যা আমরা করতে পারিনি। এবছর প্রাক্তন কিছু ফুটবলারকে আমরা হারিয়েছি। এটা একটা বিয়োগান্ত ঘটনা। যা মনকে বিষাদগ্রস্তই করে তোলে।
তবে বছর শেষে বলি, এখন ফুটবল নিয়ে যা কথাবার্তা হয় তা মেয়েদের নিয়েই। এছাড়া অন্য কিছু তো আর বলার নেই। ওরা আমাদের সাফল্য দিচ্ছে। জানি না মেয়েরা যে সাপোর্ট দিচ্ছে তাদের নিয়েও সবকিছু প্ল্যান মতো হচ্ছে কিনা। কারণ ১৮ কোটি লোকের মধ্যে চল্লিশ-পয়তাল্লিশ জন কেন? তাদের নার্সিং সব ঠিকভাবে হচ্ছে কি? আরেকটা জিনিস। শুনতে হয়তো ভালো লাগবে না। এই মেয়েরা কারা? এখন আমি যদি বলি তিন বেলা ভালো খাবারের জন্য এরা ক্যাম্পে থাকে! এদের অন্য কোন আকর্ষণ নেই! এসব অনেক ব্যাপার আছে। তবে আমি বলবো, এই মেয়েদের সাফল্যের মূল্যায়নটা যেন হয়। ওরা হারিয়ে যেন না যায়।

শফিকুল ইসলাম মানিক
এবছরটা ভালো-মন্দের মিশেলে কাটলো আমাদের। কারণ জাতীয় পুরুষ ফুটবল দল যদি বলেন তাহলে বলবো আমরা সেই জায়গাতে ব্যর্থ ছিলাম। এখানে শুধু ফেডারেশন না, খেলোয়াড়রাও ব্যর্থ ছিল। তাদের যে পারফরম্যান্স সেগুলোও তারা ধরে রাখতে পারেনি। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে জাতীয় দল ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বলবেন হয়তো, জাতীয় দলের কার্যক্রম ছিল না। কিন্তু অনূর্ধ্ব-২৩ দলের একটা টুর্নামেন্ট হয়েছে। অনূর্ধ্ব-২৩ দল মানে বেশিরভাগই জাতীয় দলের খেলোয়াড়। সেখানেও আমরা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। ছেলেদের অনূর্ধ্ব-১৬ ও অনূর্ধ্ব-১৮ দল আশার আলো দেখিয়েছে। আর অন্যদিকে যদি বিচার করি মেয়েদের ফুটবলে দারুণ সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এটা খেলোয়াড়, ফেডারেশন, মহিলা দলের কোচ সবারই সফলতা। সেই সাথে তারা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কোন জায়গাগুলোতে কাজ করলে পুরুষ ফুটবলেও সফলতা আসবে।

তৃতীয়ত, আমি বলবো ক্লাব পর্যায়ের ফুটবল নিয়ে। পেশাদার লিগের সঙ্গে অন্যান্য কিছু লিগ চালু হয়েছে। শতভাগ পেশাদারভাবে হয়তো শুরু হয়নি। তবে চালু হয়েছে এটাই বড়। বাংলাদেশ লিগটা অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতার হয়েছে। যেটা দর্শক দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছে অবশ্য। ঢাকার বাইরে যদি খেলা হতো তাহলে দর্শকরা অনেক উপভোগ করতো। দলগুলোও দারুণ খেলেছে। অতীতে যেটা দেখা যেত পাতানো খেলার ছোবল; এবার আমার মনে হয় পাতানো খেলার গন্ধ পাওয়া যায়নি। সেই হিসেবে প্রিমিয়ার লিগটা সফল। অন্যান্য প্রথম বিভাগ, চ্যাম্পিয়ন্সশিপ এসব ক্ষেত্রে পাতানো খেলার কিছুটা গন্ধ পাওয়া গেছে ঠিক। তবে মাঠে খেলা ছিল এটাই বড় পাপ্তি। সবদিক মিলিয়ে ক্লাব ফুটবল ও নারী ফুটবল এখানে আমরা সফলতা পেয়েছি। তবে যেটার দিকে মানুষ তাকিয়ে থাকে সেখানে (পুরুষ ফুটবল) আমরা পিছিয়ে ছিলাম।
ফেডারেশন যদি মনে করে আমরা সামনের দিকে সময় নিয়ে কাজ করবো, বয়সভিত্তিক ফুটবল নিয়ে কাজ করবো, তবে ছোটখাটো ব্যর্থতাগুলোর কথা মানুষ মনে রাখবে না। কারণ তারা জানবে বয়সভিত্তিক ফুটবলারদের নিয়ে কাজ হচ্ছে। আর সেজন্য আগামীতে আমরা জতীয় দলেরও সাফল্য পাবো। তবে এখনকার জাতীয় দলের দিকে না তাকিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকানোই ভালো। কারণ এখন যারা আছে তাদের সীমাবদ্ধতা কতোটুকু আমরা সবাই তা জানি।

২০১৭ সালে ফুটবলের যত সাফল্য :
*পুরুষদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ ফুটবলে রানার্স আপ হয় বাংলাদেশ।
*মেয়েদের এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের মূল পর্বে খেলে বাংলাদেশ।
*মেয়েদের প্রথম অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ।

আজকের বাজার: সালি / ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭