এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সম্মুখভাগে আঘাত

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা সংক্রান্ত আইনকে স্বাধীন বিচার বিভাগের সম্মুখভাগে আঘাত বলে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ এর বেশ কয়েকটি ধারা বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপিতে এই পর্যবেক্ষণ ওঠে এসেছে।

হাইকোর্টের ৬৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় ইতোমধ্যে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়েছে। গত ১১ মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মামলার রায় দেন। এর ফলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই বলে জানান মামলার আইনজীবীরা।

পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (প্রশাসন) সদস্য। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ ও মাসদার হোসেন মামলার আলোকে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধি সংশোধন করে নির্বাহী ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটকে আলাদা করা হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কোনো বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ সংক্রান্ত ২০০৯ সালের ৫৯ নম্বর আইন সংবিধানের লঙ্ঘন, যা বিচার বিভাগের পৃথকীকরণণের উপর সম্মুখভাগে আঘাত এবং ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির পরিপন্থি।

এতে আরও বলা হয়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের সকল সদস্য নির্বাহী প্রশাসনের অংশ। নির্বাহী বিভাগের মাধ্যমে বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ স্বাধীন বিচারিক ক্ষমতা মাসদার হোসেন মামলার পরিপন্থি। তাই ২০০৯ সালের ৫৯ নং (মোবাইল কোর্ট) আইনের ৬(১), (২), (৪), ৭, ৮ (১), ৯, ১০, ১১, ১৩, ১৫ ধারা সংবিধানের পরিপন্থি। তাই এসব ধারাকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হয় রায়ে।

রায় অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বিবাদীদের এই রায়ের কপি দ্রুত সরবরাহেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এসব ধারা অবৈধ ঘোষণা করায় কার্যত মোবাইল কোর্ট আইনের প্রয়োগই এখন আর সম্ভব নয় রায়ের পর জানিয়েছিলেন ব্যারিস্টার হাসান এস এম আজিম। তিনি বলেন, ‘মোবাইল কোর্ট আইনের বিধান সম্পর্কে আজকে হাইকোর্ট বিভাগ বলেছেন এটা অসাংবিধানিক। এসব ধারা অবৈধ ঘোষণার পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ধারা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা আর সম্ভব হবে না। কারণ মোবাইল কোর্ট পরিচালনার যে আইন ছিল সেটার অপারেটিভ পার্ট বাতিল হয়ে গেছে। এখন আর মোবাইল কোর্টের ওই ধারাগুলো কাজ করবে না।

সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন আইন করলে বিচারিক ম্যাজেস্ট্রেটদের দ্বারা তখন করতে পারবে বলেও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা করতে পারবেন। সেটা মোবাইল কোর্ট লাগবে না। নরমাল আইনেই সেটা বলা আছে।

তবে ইতোমধ্যে যেসব মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে সেগুলোর মধ্যে যেগুলো চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে মামলা চলছে তা রায় অনুযায়ী কাজ করবে। আর বাকি রায় যেগুলো হয়ে গেছে আদালত তা মার্জনা করে দিয়েছেন।

মামলা সূত্রে জানা যায়, ভবন নির্মাণ আইনের কয়েকটি ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০১১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর এসথেটিক প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান খানকে ভ্রাম্যমাণ আদালত ৩০ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। সে বছরের ২০ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পান তিনি।

এরপর ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের (মোবাইল কোর্ট অ্যাক্ট-২০০৯) কয়েকটি ধারা ও উপধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ১১ অক্টোবর কামারুজ্জামান হাইকোর্টে রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর হাইকোর্ট রুল দেন।

রুলে রিট আবেদনকারীর (কামরুজ্জামান) সাজা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি সাজার আদেশ স্থগিত করা হয়।

এছাড়া ভবন নির্মাণ আইনের কয়েকটি ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০১১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর টয়নবি সার্কুলার রোডে অবস্থিত এক বাড়ির মালিক মো. মজিবুর রহমানকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ৩০ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

আইনের বিধান চ্যালেঞ্জ ও অর্থ ফেরতের নির্দেশনা চেয়ে ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর রিট করেন মজিবুর। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই দিন হাইকোর্ট রুলসহ সাজার আদেশ স্থগিত করেন। রায়ে আদালত তার জমিরানার ১০ লাখ টাকা ৯০ দিনের মদ্যে ফেরতের নির্দেশ দেন।

এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের কয়েকটি বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১২ সালে ২ মে দিনাজপুরের বেকারি মালিকদের পক্ষে মো. সাইফুল্লাহসহ ১৭ জন আরেকটি রিট করেন। এতে বেকারিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষেত্রে খাদ্য বিশেষজ্ঞ ও পরীক্ষার জন্য যন্ত্রপাতি সঙ্গে রেখে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা চাওয়া হয়। শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৮ মে হাইকোর্ট রুলসহ অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেন।

সেই তিনটি রুলের উপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে এই রায় দেন হাইকোর্ট।