ক্লাসিক মেলামাইনের ৫ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি

মেলামাইনের তৈজসপত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ক্লাসিক মেলামাইন ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের বিরুদ্ধে ৫ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটি পণ্য বিক্রির সময় ভ্যাট চালান না দিয়ে কৌশলে ওই পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে।

সম্প্রতি মূসক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় ও কারখানায় অভিযান চালিয়ে নানা নথিপত্র আটক করলে ভ্যাট ফাঁকির ওই ঘটনা উদঘাটিত হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

জব্দকৃত দলিলাদি পর্যালোচনা করে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মূসক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা (উত্তর) সম্প্রতি ৫ কোটি টাকা মূসক ফাঁকির মামলা করেছে।

উল্লেখ, ক্লাসিক মেলামাইন ইন্ডাস্ট্রি মাহবুব গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি মেলামাইনের প্লেট, গ্লাস, বাটিসহ নানা ধরনের তৈজসপত্র উৎপাদন ও বাজারজাত করে থাকে।

ক্লাসিক মেলামাইন উৎপাদিত পণ্য বিক্রির সময় সঠিকভাবে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট পরিশোধ করছে না; মূসক চালান ছাড়াই অনেক পণ্য বিক্রি করে বিপুল ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে- এমন অভিযোগে মূসক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের দুটি দল গত বছরের ২১ ডিসেম্বর গাজীপুরের কাশিমপুরে কোম্পানির প্রধান কার্যালয় ও জয়দেবপুরে অবস্থিত কারখানায় অভিযান চালায়।

মূসক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা কারখানা কর্তৃপক্ষকে ভ্যাট সংক্রান্ত দলিলাদি দেখানোর অনুরোধ জানালে তারা মূসক পরিশোধের মাসিক দাখিলপত্র (মূসক-১৯), বিক্রয় হিসাবপুস্তক (মূসক-১৭) ও ক্রয় হিসাবপুস্তক (মূসক-১৬) প্রদান করেন।

মূসক গোয়েন্দরা অনুসন্ধানে দেখতে পান, কারখানার বাইরে বাউন্ডারি সংলগ্ন অন্য একটি বিল্ডিং থেকে ব্যক্তিগত চালানের মাধ্যমে পণ্য ডেলিভারি দেয়া হচ্ছে। এ দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা জানান, কারখানা হতে উৎপাদিত পণ্য এখানে মজুদ করে রাখা হয় এবং ক্রেতার চাহিদা মোতাবেক ডেলিভারি দেয়া হয়।

সন্দেহ হলে মূসক গোয়েন্দারা কক্ষ তল্লাশি করে পণ্য বিক্রয় সংক্রান্ত বেশ বাণিজ্যিক দলিল উদ্ধার করেন ও কক্ষের কম্পিউটার হতে কয়েক মাসের প্রকৃত বিক্রয় বিবরণী সংগ্রহ করেন। এসব দলিলাদি পর্যালোচনা করে ব্যাপক অসঙ্গতি পাওয়া যায়।

কারখানা হতে ব্যক্তিগত রেজিস্টার, ক্লিপ ফাইল, কম্পিউটারের বিক্রয় হিসাব, মানি রিসিট, ব্যক্তিগত মুড়ি চালান বই, ব্যক্তিগত চালান, চলতি হিসাব রেজিস্টার, ক্রয় ও বিক্রয় হিসাব রেজিস্টার, দাখিলপত্র, ট্রেজারি চালান, বিল অব এন্ট্রি, উৎপাদন রিপোর্ট ফাইলসহ বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করা হয়।

ক্লাসিক মেলামাইনের কারখানায় ক্লাসিক ফাইবারেরও উৎপাদন কার্যক্রম চালানো হয়। অথচ দুইটি প্রতিষ্ঠান পৃথক পৃথক ভাবে মূসক এর আওতায় নিবন্ধিত।

কারখানা ও গুদামে দুটি প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য এমনভাবে এলোমেলো করে রাখা হয় যে, কোন পণ্য কোন প্রতিষ্ঠানের তা আলাদা করা কঠিন।

সব নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ক্লাসিক মেলামাইন ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত স্থানীয়ভাবে ৩১ কোটি ৫৩ লাখ টাকার পণ্য বিক্রয় করলেও মূসক দাখিলপত্রে (মূসক রিটার্ন) মাত্র ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা দেখিয়েছে।

এভাবে ২০ কোটি ১৩ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি কম দেখিয়ে ৬ বছরে প্রতিষ্ঠানটি ৩ কোটি ২ লাখ টাকার মূসক ফাঁকি দিয়েছে।

মূসক আইন, ১৯৯১ এর ৩৭ (৩) অনুযায়ী ফাঁকিকৃত মূসক এর ওপর সুদ ধার্য হয় ২ কোটি ৬ লাখ টাকা। সে হিসেবে ৬ বছরে প্রতিষ্ঠানটি সুদসহ ৫ কোটি ৮ লাখ টাকার মূসক ফাঁকি দিয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, প্রতিষ্ঠানটি মেলামাইন মোল্ডিং পাউডার, মেলামাইন গ্লোজিং পাউডারসহ কাঁচামাল মজুদের সঠিক হিসাব রাখে না। এর মাধ্যমেও মোটা অংকের রাজস্ব ফাঁকি দেয়।

ক্লাসিক মেলামাইন ও ক্লাসিক ফাইবার নামক দুইটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান একই ঠিকানায় পৃথকভাবে মূসক নিবন্ধন নিয়েছে। কিন্তু মূসক ফাঁকি দিতে দুইটি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য ও কাঁচামাল এক সাথে এলোমেলো করে রাখে।

হিসাব শেষে ক্লাসিক মেলামাইন ইন্ডাস্ট্রির বিরুদ্ধে ৫ কোটি ৮ লাখ ৭৪ হাজার ৩২৬ টাকার মূসক ফাঁকির অভিযোগে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকা (উত্তর) মামলা করে।

মামলায় প্রতিষ্ঠানটির মূসক ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বেশি থাকায় নজরদারি বৃদ্ধি, পণ্য বিক্রয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে মূসক-১১ নিশ্চিত, মাসিক দাখিলপত্র মূল্যায়ন ও দুইটি প্রতিষ্ঠানের পণ্য, কাঁচামাল আলাদা হিসাব করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়।

অপরদিকে ক্লাসিক ফাইবারের দলিলাদি পর্যালোচনা করে ২ কোটি ৩৩ লাখ টাকার মূসক ফাঁকির তথ্য পাওয়া যায়। ফাঁকিকৃত মূসকে সুদ ৯২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। এ হিসেবে ৬ বছরে ক্লাসিক ফাইবারের মোট ভ্যাট ফাঁকি দাঁড়ায় ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এ কোম্পানির বিরুদ্ধে মূসক ফাঁকির আলাদা একটি মামলা করা হয়।

এ বিষয়ে ক্লাসিক মেলামাইন ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের ম্যানেজার (ভ্যাট এন্ড ট্যাক্স) মো. হাবিবুর রহমান বলেন, মূসক-১১ চালান না দেওয়াসহ যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, আমরা তার জবাব দিয়েছি।

তিনি বলেন, মূসক গোয়েন্দাদের দেওয়া পর্যবেক্ষণ দিয়েছে ঠিক নয়। আমরা সঠিক দলিলাদি দিয়েছি। যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, বাস্তবতার সঙ্গে তার কোনো মিল নাই। বিষয়টি আমরা আইনগতভাবে মোকাবেলা করছি। কোনো প্রতিষ্ঠানকে এমন মামলা দিয়ে যাতে ‘হয়রানি’ না করার অনুরোধ জানান তিনি।

সূ্ত্র:অর্থসূচক

আজকের বাজার: এলকে/এলকে ০৮ আগস্ট ২০১৬