দরিদ্র সামাদের অটোরিকশা মালিক হওয়ার গল্প

শাহজাহান সাজু, ধামরাই থেকে ফিরে:
ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলার দেপাশাই বড় পাড়ার আব্দুস সামাদের জন্ম দরিদ্র পরিবারে। তার বাবা আব্দুল বেপারি ছিলেন খুবই দরিদ্র। দুই ভাই এবং এক বোনের সংসারে আব্দুস সামাদ ছিলেন সবার ছোট। জন্মের পর তিন মাস বয়সে ভুল চিকিৎসার কারণে তিনি সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। এর কিছুদিন পরই তিনি পিতাকে হারান। স্বামী হারিয়ে অন্ধ ছেলে আব্দুস সামাদকে নিয়ে জীবন যুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন তার মা। কিছু দিন তিনিও বিদায় নেন। এ অবস্থায় ভাই-বোনেরা মিলে তাকে লালন-পালন করতে থাকেন। আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকায় ছোটবেলা থেকেই রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজারে মানুষের কাছে সাহায্যের জন্য ভিক্ষার হাত বাড়াতে শুরু করেন। অন্ধ হওয়ায় কোনো কাজকর্ম করার শক্তি-সামর্থ্য না থাকায় ভিক্ষাবৃত্তিকেই উপযুক্ত পেশা হিসেবে বেছে নিতে হয় তাকে।

আব্দুস সামাদের এই মানবেতর জীবন-যাপন দেখে এলাকার কিছু মানুষ সদয় হয়ে তাদের গ্রামেরই গরীব ঘরের এক মেয়ের সঙ্গে ১৯৭১ সালে আব্দুস সামাদকে বিয়ে দিলেন। তার এক ছেলে তিন মেয়ে ছেলে-মেয়ে যতদিন ছোট ছিল, ততদিন বাবার সাথে তারাও ভিক্ষা করত। ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমেই তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেটা বড় হয়ে একটা গার্মেন্টস কোম্পানিতে চাকরি নেয়। সংসারের অভাব একটু কমবে; এই আশা করেন বাবা। কিন্তু আব্দুস সামাদের আশার সমাধি টেনে এক গার্মেন্টস কর্মীকে বিয়ে করে স্ত্রীর হাত ধরে বাড়ি থেকে চলে যায় তার ছেলে। এরপর থেকে ছেলে বাবা-মায়ের কোন খোঁজ নেয় না। আব্দুস সামাদের ভিক্ষাবৃত্তিও বন্ধ হয় না।

দূর হয় না সংসারের অভাবও। দিনে দিনে তার বয়স বাড়তে থাকে। ছেলে-মেয়েরা কেউ কাছে নেই। ছেলে দূরে চলে যাওয়াতে আব্দুস সামাদের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। বৃদ্ধ বয়সেও ভিক্ষা করেই তাকে জীবন চালাতে হচ্ছিল। এই অবস্থায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘সজাগের (সমাজ ও জাতি গঠন) সমৃদ্ধি কর্মসূচির কর্মকর্তারা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সমৃদ্ধি কর্মসূচির সদস্যরা আব্দুস সামাদের জীবন বৃক্তান্ত শুনেন এবং পুনর্বাসন কার্যক্রম সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন। ভিক্ষুক পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় পিকেএএফ বা পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় এবং সজাগের সমৃদ্ধি কর্মসূচির মাধ্যমে তাকে একটি উন্নত জাতের দুগ্ধবতী গাভী কিনে দেওয়া হয়। একইসঙ্গে গাভী লালন-পালনের জন্য একটি তৈরি ঘরও পান তিনি ।

গাভীর খাবার কেনার জন্য এবং গাভীর নিয়মিত চেকআপ করে প্রয়োজনীয় ওধুধ ক্রয়ের জন্য টাকা দেওয়া হয়। এছাড়া তার পরিবারের সকল সদস্যকে সমৃদ্ধির স্বাস্থ্যকর্মসূচির আওতায় স্বাস্থ্য সেবা ও পুষ্টি কার্যক্রমের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে গাভীর খাবারের জন্য ঘাস কেটে সময় কাটান। প্রতিদিন গড়ে আট থেকে নয় লিটার দুধ বিক্রি করতে পারেন তিনি। যার বাজার মূল্য প্রায় ৪০০ টাকা। এই টাকা থেকে তার সংসার এবং গাভীর খরচ মিটিয়ে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে বিশেষ সঞ্চয় হিসাবে জমা করেন। এখন তার মোট সঞ্চয়ের পরিমাণ ১৬ হাজার ৫০০ টাকা। পরিবারে স্বচ্ছলতা এসেছে। জমানো টাকা দিয়ে সংসার চালান। পিতার স্বচ্ছলতা, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়াতে এখন তার ছেলে ও ছেলের বউ বাড়িতে চলে এসেছে। আব্দুস সামাদ তার ছেলেকে একটি সিএনজি কিনে দিয়েছেন দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে।

এ বিষয়ে আব্দুস সামাদ বলেন,সজাগ এবং পিকেএসএফের প্রতি আমি চির ঋণী। কারণ তাদের সহযোগিতার কারণেই আমি বৃদ্ধ বয়সে এসে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। ফলে আমার সামাজিক মর্যাদা বেড়েছে। এ ধরনের কর্মসূচি সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার বলে জানান তিনি।

বর্তমানে আব্দুস সামাদের পরিবার দেখে বুঝার উপায় নেই যে তিন-চার বছর আগেও অন্যের কাছে হাত না পাতলে চুলায় আগুন জ্বলতো না। সজাগ ও পিকেএসএফের সমৃদ্ধি কর্মসূচি তার বেঁচে থাকা এবং সংগ্রামী জীবনকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ করে দিয়েছে।

আজকের বাজা : এসএস / ডিএইচ/ আরআর/ ১০ ডিসেম্বর ২০১৭