সন্তান মাদকাসক্ত, বুঝবেন যেভাবে

ছবি : ইন্টারনেট

পৃথীবির সকল বাবা-মার কাছেই সন্তান সর্বাপেক্ষা প্রিয়। আর কোন বাবা-মা কখনো চান না তার প্রিয় সন্তানটি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ুক। আর বিষয়টি নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তারও শেষ নেই। আপনার সন্তান মাদকাসক্ত কিনা তা বুঝতে পারবেন সন্তানের কিছু কার্যকলাপ পর্যালোচনার মাধ্যমেই।

‘অ্যা প্যারেন্ট’স গাইড টু টিন অ্যাডিকশন’র লেখক, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের সাইকিয়াট্রি বিভাগের ক্লিনিক্যাল অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং অ্যাডিকশন সাইকিয়াট্রিস্ট লরেন্স এম. ওয়েস্টরেইক কিশোরদের ড্রাগ সেবন চিহ্নত করার উপায় বিষয়ক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। রিডার্স ডাইজেস্টে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনটি আপনার সন্তান মাদকাসক্ত কিনা তা বুঝতে সহায়তা করবে।

১. সচরাচরের চেয়ে বেশি নিদ্রালু বা উত্তেজিত দেখাবে
আবেগের উত্থান-পতন জীবনের অংশ। টিনেজার বা কিশোরদের ক্ষেত্রে এটি বেশি ঘটে। যদি আপনার কিশোর সন্তানের মধ্যে টেবিলে ঘুমিয়ে পড়া কিংবা স্কুলশেষে দীর্ঘ ন্যাপ বা ঘুম যাওয়ার মতো অভ্যাস দেখা যায়, তাহলে তা দেরিতে ঘুম যাওয়ার রেজাল্ট নয়। বিপরীতভাবে, যদি আপনার কিশোর সন্তান রিল্যাক্স হতে না পারে অথবা কোনো সুস্পষ্ট কারণ ছাড়া নার্ভাস বা ভীত থাকে, তাহলে সন্দেহ করতে পারেন যে সে মাদক সেবন করছে। আপনার কিশোর সন্তানের মধ্যে অত্যধিক ক্লান্তি বা উত্তেজনা কিংবা উভয় দেখা দিলে তাকে একজন ক্লিনিশিয়ান বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারেন।

২. খিটখিটে হতে পারে এবং আপনার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিতে পারে
অভিমান করা বা বিরক্ত হওয়া এবং কথাবার্তা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে কিশোরদের কমন বৈশিষ্ট্য। যদি আপনার কিশোর সন্তান আপনার সঙ্গে সবরকম কমিউনিকেশন বা যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়, তাহলে আপনার তার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা উচিত। মাদক ব্যবহার করার কারণে সে এমনটা করতে পারে। আপনি নীরবে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। সে মাদকের সঙ্গে জড়িত হোক বা না হোক, আপনি শব্দগতভাবে কিংবা শারীরিকভাবে তাকে আঘাত দেবেন না, কিন্তু একেবারে কেনোকিছু বলবেন না তাও নয়। আপনি কৌশলে কিন্তু কোমল ভাষায় কথা বলতে পারেন, যেমন- ‘আমি জানি, তুমি এখন আমার সঙ্গে কোনো কথা বলতে চাচ্ছো না, কিন্তু মনে রাখবে আমি সবসময় তোমার পাশে আছি এবং তোমার যেকোনো প্রয়োজনে আমি সাহায্য করতে পারি।’

৩. বন্ধু পরিবর্তন করে
কিশোরদের বিহেভিয়ারে সঙ্গীদের প্রচুর প্রভাব পড়ে, তাই সে কি রকম বন্ধু নির্বাচন করছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি এবং আপনার পরিবারও কিশোর সন্তানের বিহেভিয়ারে প্রভাব ফেলেন, যা সে অ্যাডমিট করতে পারে বা নাও করতে পারে। যদি আপনার কিশোর সন্তান এমন বন্ধু নির্বাচন করে যারা মাদক বা অ্যালকোহল সেবনকারী, তাহলে তাকে তাদের সঙ্গে মিশতে নিষেধ করুন, এটা বলতে হেজিটেশনে ভুগবেন না যে তাদের কেউ কেউ খারাপ কাজে প্রভাবিত। আপনার সন্তান আপনাকে এড়িয়ে যাতে তাদের সঙ্গে মিশতে না পারে সে ব্যাপারে প্রস্তুত থাকুন। যদি আপনার সন্তান তাদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে, তবে তারও মাদক সেবনের ঝুঁকি থাকে।

৪. সচরাচরের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে
আপনার সন্তানের অর্থব্যয়ের কারণ আপনি বুঝতে না পারলে বা আপনাকে না জানালে, তবে এটাকে জরুরি সতর্ক সংকেত হিসেবে ধরে নিতে পারেন। তাদের যেকোনো অজ্ঞাত ব্যয় কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি করে, যেমন- প্রতি সপ্তাহে তুমি কত টাকা খরচ কর, তুমি কাদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাও বা ঘুরতে যাও? যদি আপনি লক্ষ্য করেন যে আপনার সন্তানের হাত থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ চলে যাচ্ছে, তাহলে সন্দেহ করতে পারেন যে সে মাদক সেবন করে বা অস্বাভাবিক কোনোকিছু করে। তাদের অজ্ঞাত ব্যয়ের উৎস অনুসন্ধানে কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করুন এবং খারাপ উৎস পাওয়া গেলে তা থেকে আপনার সন্তানকে দূরে রাখার উপায় অবলম্বন করুন।

৫. স্কুলওয়ার্ক কমে যায়
যদি আপনার কিশোর সন্তানের স্কুলওয়ার্কের মান বা স্কুলওয়ার্ক কমে যায় অথবা হঠাৎ করে বিহেভিয়ার সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে মাদককে সম্ভাব্য কালপ্রিট হিসেবে সন্দেহ করতে পারেন। যে কাউন্সেলর আপনাকে ডেকেছেন তার সঙ্গে কথা বলুন এবং স্কুলের সবার সঙ্গে কথা বলে আপনার সন্তানের সমস্যা সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করুন। শিক্ষক, প্রশাসক, প্রশিক্ষক এবং সেবাদাতার পুরো নেটওয়ার্কের সঙ্গে কথা বলুন, যারা আপনার সন্তানের সমস্যার কারণ উদঘাটন করতে সাহায্য করতে পারে। প্রয়োজনে কনসালটেশনের জন্য কোনো বিশেষজ্ঞের কাছে যান।

৬. খাওয়ার অভ্যাস পরিবর্তন হয়
যদি আপনার কিশোর সন্তান হঠাৎ করে খাওয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং দ্রুত ওজন হ্রাস পায় বা বৃদ্ধি পায়, তাহলে ড্রাগকে এর একটি কারণ ভাবতে পারেন। কোকেন বা অ্যাম্ফিট্যামাইনের মতো উত্তেজক কোনোকিছু সেবনে ওজন হ্রাস পেতে পারে। এমনকি কিছু কিশোর ওজন কমানোর উদ্দেশ্যে এসব মাদক সেবন করে। আপনার কিশোর সন্তান খাওয়ার প্রতি উদাসীনতা দেখালে, ওজন হ্রাস পেলে, খুব অলস হয়ে পড়লে, অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগে অনীহা দেখালে এবং ওজন বৃদ্ধি পেলে পিডিয়াট্রিশিয়ান বা ক্লিনিশিয়ানের কাছে নিয়ে যেতে পারেন। পিডিয়াট্রিশিয়ানকে আপনার সন্তান সম্পর্কে আপনার উদ্বেগের ব্যাপারে জানান। প্রায়ক্ষেত্র পিডিয়াট্রিশিয়ানদের অ্যাডিকশন সমস্যার জন্য ভালো রেফারেল নেটওয়ার্ক থাকে এবং তারা আপনার সন্তানকে চিকিৎসার জন্য এমনভাবে মোটিভেট করতে পারেন যা আপনি পারেন না। আপনার সন্তানের সঙ্গে মাদক বা অ্যালকোহল সম্পর্কে আলাপ করতে যেন ভুলে না যান।

৭. প্রিয় কার্যকলাপের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে
নতুন কাজ এবং লক্ষ্য নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে আপনার কিশোর সন্তানকে অনুমতি দেওয়া উচিত। কিন্তু আপনার সন্তান হঠাৎ করে কোনো কিছুর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললে বা আগ্রহ একেবারেই অনুপস্থিত থাকলে, তাহলে তা মাদক সমস্যার সম্ভাব্য ইঙ্গিত হতে পারে। ক্লান্তি, উদাসীনতা এবং কোনোকিছু করার জন্য মোটিভেশনের অভাবে ফেলতে মারিজুয়ানা ড্রাগ কুখ্যাত। আপনার সন্তান কোনোকিছুর প্রতি আগ্রহ হারালে অথবা হোমওয়ার্ক, স্পোর্টস, ক্লাব ও দলের কার্যক্রমে লেগে থাকতে ব্যর্থ হলে আপনার পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। মারিজুয়ানা এবং অন্যান্য মাদক কোনো কিশোরের উদ্যম থামিয়ে দেয় বা হ্রাস করে, তার অ্যাকাডেমিক উজ্জ্বল সম্ভাবনা এবং সামাজিক দক্ষতা অর্জনে বাধা দেয়।

৮. শারীরিক স্বাস্থ্য অধিকতর খারাপ হয়
আপনার কিশোর সন্তানের অজুহাতে বোকা বনে যাবেন না: যদি তার রক্তরাঙা চোখ, বিস্তৃত পিউপিল বা শরীরে খোঁস-পাঁচড়া থাকে, তাহলে মনে করতে পারেন যে সে মাদক সেবন করে। ঘনঘন ব্লাডি নোজ বা রানি নোজ অথবা মুখ, ঠোঁট বা হাতে যেকোনো ধরনের ক্ষত হতে পারে কোকেন বা মিথঅ্যাম্ফিট্যামাইন ব্যবহারের লক্ষণ। শরীরের কোনো অংশ ঢেকে রাখার মানে হল আপনার সন্তান কোনো শারীরিক সমস্যাকে আপনার কাছ থেকে লুকানোর চেষ্টা করছে। আপনার সন্তানকে পর্যবেক্ষণ করে কোনো পিডিয়াট্রিশিয়ান বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান এবং প্রয়োজনে রেফারেল বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হোন।

৯. ড্রাগ অথবা ড্রাগ প্যারাফারনেলিয়া আছে
অ্যাডিকশন গোপনে বিস্তৃত হয়, তাই আপনার কিশোর সন্তানের ব্যাগে অজ্ঞাত পিল, পাইপ, সিরিঞ্জ বা অন্যান্য উপাদান পাওয়া গেলে অন্যান্য স্থানেও খুঁজে দেখুন। আপনার সন্তানের রুম বা জিনসপত্র চেক করতে দ্বিধা করবেন না। তার বন্ধুবান্ধব বা শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলুন। আমাদের মধ্যে অধিকাংশই ছেলেমেয়েদের প্রাইভেসি রেসপেক্ট করেন, কিন্তু ড্রাগ সমস্যার ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই হস্তক্ষেপ করতে হবে, তা না হলে তাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। আপনার সন্তানকে ড্রাগ অ্যাডিকশন থেকে মুক্ত করতে কোনো অ্যাডিকশন সাইকিয়াট্রিস্ট বা রেফারেল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। তথ্যসূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট

আরএম/