জয় দিয়ে ঐতিহাসিক সিরিজ স্মরণীয় করে রাখতে চায় পাকিস্তান

অবশেষে দীর্ঘ দশ বছর পর নিজ মাটিতে শ্রীলংকার বিপক্ষে দ্বিপক্ষীয় ওয়ানডে সিরিজ খেলতে নামছে পাকিস্তান। আগামীকাল শুরু হচ্ছে পাকিস্তান-শ্রীলংকার মধ্যকার তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ। তিনটি ম্যাচই হবে করাচিতে। বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টায় শুরু হবে সিরিজের প্রথম ম্যাচটি।

২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দেশের মাটিতে শ্রীলংকার বিপক্ষে সর্বশেষ ওয়ানডে সিরিজ খেলেছিলো পাকিস্তান। ঐ সফরে টেস্ট সিরিজে লাহোরে দ্বিতীয় ম্যাচের আগে শ্রীলংকা দলবহনকারী বাসে জঙ্গী হামলার পর পাকিস্তানের মাটিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নির্বাসন ঘটে। অবশ্য ২০১৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের হোম সিরিজ হিসেবে লাহোরে তিন ম্যাচ সিরিজের ১টি টি-২০ ম্যাচ খেলেছিলো শ্রীলংকা। এবার দীর্ঘ দশ বছর পর পাকিস্তানে সিমিত ওভারের পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলছে লংকানরা। তবে নিরাপত্তা শংকায় এবারের পাকিস্তান সফরে শ্রীলংকার সিনিয়র খেলোয়াড়ই দলের সাথে আসেনি। তারপরও ২০০৯ সালের পর করাচিতে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ আয়োজন করতে পারাকে ঐতিহাসিক বলে অ্যাখায়িত করছে পাকিস্তান।

২০০৯ সালে ওয়ানডে সিরিজ দিয়ে পাকিস্তান সফর শুরু করেছিলো শ্রীলংকা। তিন ম্যাচের সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতেছিলো লংকানরা। তিন ম্যাচের প্রথম দু’টি হয়েছিলো করাচিতে, শেষটি হয় লাহোরে। ওয়ানডে সিরিজ শেষে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজের মুখোমুখি হয় পাকিস্তান-শ্রীলংকা। করাচিতে প্রথম টেস্ট ড্র হয়। এরপর লাহোরে দ্বিতীয় ম্যাচে মুখোমুখি হয় দু’দল। প্রথম দু’দিন মাঠে ব্যাট-বলের লড়াই করে পাকিস্তান-শ্রীলংকা। তৃতীয় দিন হোটেল থেকে স্টেডিয়ামের উদ্দেশ্যে বের হয় শ্রীলংকা দলকে বহনকারী টিম বাস। স্টেডিয়ামের কাছাকাছি লিবার্টি স্কয়ার থেকে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে পৌঁছানোর মুখে সন্ত্রাসী হামলার মুখে পড়ে শ্রীলংকাকে বহন করা টিম বাসটি। ১২জন সন্ত্রাসী বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র নিয়ে প্রায় ২০ মিনিট ধরে শ্রীলংকার বাস ও আশে-পাশে গোলাবর্ষণ করে। এতে ছয় পাকিস্তানী পুলিশ ও দুই বেসামরিক ব্যক্তিসহ আট ব্যক্তি নিহত হন। শ্রীলংকা দলের সাত খেলোয়াড়সহ কোচিং স্টাফের বেশ কয়েকজন আহত হন। আহতদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দিয়ে হেলিকপ্টারে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় শ্রীলংকার খেলোয়াড়দের। সেখানে পৌঁছানোর সাথে সাথে দেশে ফেরত পাঠানো হয় শ্রীলংকানদের। ফলে দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়

ঐ সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে পাকিস্তানের মাটিতে বিশ্বের কোন দলই ক্রিকেট খেলতে আগ্রহী দেখায়নি। তাই পাকিস্তানের হোম ভেন্যু হয়ে যায় নিরপেক্ষ সংযুক্ত আরব আমিরাত। সেখানে নিজেদের হোম সিরিজগুলো খেললেও, এর মাঝে দেশের মাটিতে ক্রিকেট ফেরাতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যায় পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)। বিভিন্ন দেশের ক্রিকেট বোর্ড ও আইসিসি’র সহায়তার জন্য মুখিয়ে থাকে তারা।

অবশেষে ২০১৫ সালে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দলকে নিজ দেশের এনে সিরিজ আয়োজন করে। ফলে ছয় বছর পর আবারো পাকিস্তানের মাটিতে কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। জিম্বাবুয়ে তিন ম্যাচের ওয়ানডে ও দুই ম্যাচের টি-২০ সিরিজে অংশ নেয়। পাঁচটি ম্যাচই হয়েছিলো লাহারে।

জিম্বাবুয়ের পর আর কোন দল পাকিস্তানের মাটিতে ওয়ানডে খেলেনি। আর ২০০৯ সালে শ্রীলংকার পর আর কোন দল পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট খেলেনি। ২০১৫ সালে জিম্বাবুয়েকে এনে বিশ্বের অন্যান্য ক্রিকেট দেশের মন গলানোর চেষ্টা করে পিসিবি। কিন্তু তাদের সব চেষ্টাই বিফলে যায়। তবে ২০১৭ সালে নিজেদের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে বিশ্ব একাদশের সাথে তিন ম্যাচের টি-২০ সিরিজ আয়োজন করে পিসিবি। একই বছর শ্রীলংকার বিপক্ষে তিন ম্যাচের টি-২০ সিরিজ খেলে পাকিস্তান। এরমধ্যে প্রথম দু’টি অনুষ্ঠিত হয় আবু ধাবিতে, শেষটি হয় লাহোরে। এই দু’টি সিরিজ শেষে ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে করাচিতে তিন ম্যাচের টি-২০ সিরিজ আয়োজন করে পাকিস্তান। তারপরও পাকিস্তানের খেলতে যাবার জন্য মন গলেনি বিশ্ব ক্রিকেটের দলগুলোর।

তবে এবার শ্রীলংকা ক্রিকেট বোর্ডকে (এসএলসি) পাকিস্তানে আসার জন্য রাজি করায় পিসিবি। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেয়ার শর্তে রাজিও হয় এসএলসি। কিন্তু দল ঘোষনার আগেই বেকে বসেন দলের ১০জন সিনিয়র খেলোয়াড়। লাসিথ মালিঙ্গা, দিমুত করুনারতে, অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ, দিনেশ চান্ডিমালের মত খেলোয়াড়রা জানিয়ে দেন- পাকিস্তান সফরে যেতে আগ্রহী নন তারা। ফলে জাতীয় দলের কিছু খেলোয়াড়ের সাথে ‘এ’ দল, অনূর্র্ধ্ব-২৩ দল থেকে ক্রিকেটার নিয়ে স্কোয়াড সাজায় এসএলসি।
পাকিস্তান সফরের জন্য দল ঘোষণার পরের দিন এসএলসি জানায়, ‘দেশটির ক্রিকেট দলের ওপর পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার হুমকি পেয়েছে তারা। তাই আবারো অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায় সফরটি।’

এক বিবৃতিতে এসএলসি আরও জানিয়েছিলো, ‘পাকিস্তান সফরের নিরাপত্তা নিয়ে শ্রীলংকা ক্রিকেট আবারও পুনর্বিবেচনা করবে। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে আসা নির্দেশ অনুযায়ী এই সিন্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’

তবে সব শংকাকে উড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজ খেলতে যায় শ্রীলংকা। দীর্ঘ দশ বছর পর সেই শ্রীলংকার সাথে দেশের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজ খেলতে পারবে পাকিস্তান, এতেই খুশী পিসিবি। সিরিজ শুরু হওয়া আগে উচ্ছসিত পাকিস্তান অধিনায়ক সরফরাজ বলেন, ‘২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের পর করাচিতে প্রথম দ্বিপাক্ষিক ওয়ানডে সিরিজ দিয়ে শুক্রবার ইতিহাস সৃষ্টি হবে। স্থানীয় সকল ভক্ত-সমর্থকদের প্রতি আমি আহবান জানাচ্ছি ইতিহাসের সাক্ষী হতে, যাতে তারা ভবিষ্যত প্রজন্মকে বলতে পারে একটি আন্তর্জাতিক সিরিজে তারা জাতীয় স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিলেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘স্মরণীয় উৎসবে পরিণত হতে যাওয়া শুক্রবারের জন্য আমার তর সইছেনা। আশা করছি আমি মাঠে নামার সময় পুরো স্টেডিয়াম আমার পাশে থাকবে। কেবল আমার জন্য গলা ফাঁটাবে তাই নয়, পুরো দলের পাশে থাকবে যে কোন খেলার প্রাণ হচ্ছে ভক্ত-সমর্থক, যে কোন দল এবং খেলার মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে তারা। ভক্ত সমর্থকরাই একটা দলকে শক্তি যোগায় এবং তাদের সেরাটা বের করে আনতে সহায়ক ভূমকা পালন করে। একটি দ্বিপাক্ষিক ওয়ানডে সিরিজে আমার নিজ মাঠে পাকিস্তান দলকে নেতৃত্ব দিতে পারাটা হবে আমার ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর একটি।’

আসন্ন সিরিজের জন্য সহ-অধিনায়ক নির্বাচিত হওয়া বাবর আজম বলেন, ‘নিজ মাঠে সহ-অধিনায়ক হিসেবে প্রথম ওয়ানডে হবে আমার ‘সেরা দিনগুলোর’ একটি। আমার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ভক্ত-সমর্থকদের কাছ থেকে যে ভালবাসা ও সম্মান পেয়েছি তার জন্য তাদের প্রতি আমি সঠিকভাবে শ্রদ্ধা জানাতে পারিনি। পাকিস্তান দলের সহ-অধিনায়ক হিসেবে মাঠে নামার দিন শুক্রবার হবে আমার জীবনের ‘সেরা দিনগুলোর’ একটি। আমি চাইব পুরো দেশ তথা জাতীয় স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকরা এই দিনটি আমার জন্য স্মরণীয় করে রাখুক।’

বিশ্বকাপে ব্যর্থতার কারণে পাকিস্তানের কোচের পদ থেকে বরাখাস্ত করা হয় মিকি আর্থারকে। ফলে পাকিস্তানের প্রথম কোচ ও প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব পান সাবেক অধিনায়ক মিসবাহ-উল-হক। আর প্রথম দায়িত্বও তিনি পাচ্ছেন দেশের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজে। এতে আবেগে আপ্লুত মিসবাহ, ‘আবারো পাকিস্তানের মাটিতে ক্রিকেট ফিরছে। আর দেশের হয়ে নতুন ক্যারিয়ার শুরু করতে যাচ্ছি আমি। ভাবতেই শিহরিত হয়ে উঠতে হচ্ছে আমাকে। এই সিরিজের দলের জন্য যা যা করা দরকার সবই আমি করবো। আমার চেষ্টার কমতি থাকবে না।’

খেলোয়াড় হিসেবে করাচিতে শেষ ওয়ানডে খেলেছিলেন মিসবাহ। ২০০৯ সালে শ্রীলংকার বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। চার নম্বরে ব্যাট হাতে নেমে ১ রান করেছিলেন মিসবাহ। দশ বছর আগের শেষ ওয়ানডের স্মৃতি চারণ করে মিসবাহ বলেন, ‘একজন খেলোয়াড় হিসেবে জাতীয় স্টেডিয়ামের শেষ ওয়ানডে ম্যাচটিও খেলেছিলাম এই শ্রীলংকার বিপক্ষেই। তাই শুক্রবারের ম্যাচটি আমার জন্য খুবই আবেগপূর্ণ। দশ বছর পর এখানেই পাকিস্তান জাতীয় দলের কোচ হিসেবে শুরু হচ্ছে আমার।’

দলের সিনিয়রা না আসায় ওয়ানডে সিরিজে শ্রীলংকাকে নেতৃত্ব দিবেন বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান লাহিরু থিরিমান্নে। সিরিজটি সফলভাবে সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদি তিনি। থিরিমান্নে বলেন, ‘আমরা বোর্ডের নির্দেশে এখানে এসেছি। আমাদের সকল ধরনের নিরাপত্তা দিবে পিসিবি। তবে আমাদের মূল কাজ ক্রিকেট খেলা। আমরা মাঠের খেলায় সবচেয়ে বেশি মনোযোগি থাকবো। জয় দিয়ে সিরিজ শুরু করতে পারলে দারুন হবে। এমনকি সিরিজটি জিততে পারলেও, খুব ভালো হবে।’
প্রথম ওয়ানডের পর ২৯ সেপ্টেম্বর এবং ২ অক্টোবর করাচিতেই অনুষ্ঠিত হবে সিরিজের বাকী দু’ওয়ানডে। এরপর ৫ অক্টোবর থেকে লাহোরে তিন ম্যাচের টি-২০ সিরিজ খেলবে পাকিস্তান-শ্রীলংকা।

পাকিস্তান দল : সরফরাজ আহমেদ(অধিনায়ক), বাবর আজম (সহ-অধিনায়ক), আবিদ আলী, ফখর জামান, হারিস সোহেল, ইফতিখার আহমেদ, ইমাদ ওয়াসিম, ইমাম উল হক, মোহাম্মদ আমির, মোহাম্মদ হাসনাইন, মোহাম্মদ নওয়াজ, মোহাম্মদ রিজওয়ান, সাদাব খান, উসমান শিনওয়ারি, ওয়াহাব রিয়াজ।

শ্রীলংকা দল : লাহিরু থিরিমান্নে (অধিনায়ক), দানুশকা গুনাথিলাকা, সাদিরা সামারাবিক্রমা, অভিষেক ফার্নান্দো, ওশাদা ফার্নান্দো, শেহান জয়সুরিয়া, দাসুন শানাকা, মিনোদ ভানুকা, অ্যাঞ্জেলো পেরেরা, ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গা, লক্ষণ সান্দ্কান, নুয়ান প্রদীপ, ইসুরু উদানা, কাসুন রাজিথা, লাহিরু কুমারা।

আজকের বাজার/লুৎফর রহমান