মানুষ হইতে হবে এ যার পন

কতটা পথ পেরোলে তবে মানুষ হওয়া যায়?‌

তাঁকে নিয়ে লিখতে গেলে বব ডিলানের গানের কথা ধার করতেই হয়। সত্যিই, আরও কতটা পথ পেরোলে ‘‌মানুষ’‌ হতে পারবেন তিনি?‌

স্টিভ স্মিথ। এই মুহূর্তে বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম বর্ণময় চরিত্র। শুরু থেকেই সাফল্য এবং বিতর্ক যাঁর জীবনে পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে। যাঁকে একদা খোদ স্যর ডন ব্র‌্যাডম্যানের পাশে বসানো হত, তিনিই কেরিয়ারের মধ্যগগনে হয়ে গেলেন বল–বিকৃতি কাণ্ডে যুক্ত কলঙ্কিত নায়ক। সদ্যসমাপ্ত অ্যাশেজ সিরিজ তাঁর হারানো গরিমা অনেকটা ফিরিয়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সমালোচকদের মুখ পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেনি। আরও কতটা পথ পেরোতে হবে তাঁকে?‌

ক্রিকেটে এমন উদাহরণ অনেক আছে, যেখানে প্রতিভাবান হয়েও কেউ কেউ বাইশ গজকে বিদায় জানিয়েছেন কলঙ্কিত নায়ক হিসেবে। কিন্তু স্মিথের মতো একইসঙ্গে প্রতিভাবান এবং কলঙ্কিত নায়কের উদাহরণ খুব একটা পাওয়া যাবে না।

সিডনির কোগারা পরিচিত বন্দর এলাকা হিসেবে। হাজার ষোলো মানুষের বসবাসকারী এই শহরে ছড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস। সেখানেই ১৯৮৯ সালের ২ জুন জন্ম স্মিথের। বাবা পিটার রসায়ানাগারে কাজ করতেন। ইংল্যান্ডে কাজ করতে গিয়ে আলাপ সুন্দরী গিলিয়ানের সঙ্গে। সেখানেই প্রেম এবং বিয়ে করে দেশে প্রত্যাবর্তন। অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম নিল তাঁদের এক কন্যাসন্তান। অতঃপর পুত্র। স্টিভেন স্মিথ।

ছোট থেকেই ছেলের ক্রিকেটের প্রতি টান। মূলত বাবার অনুপ্রেরণাতেই খেলা শুরু। কাজের পর ছেলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলা ছিল পিটারের রুটিন। ছেলে বড় হলেও সেই টান এখনও অটুট। কেপ টাউন কাণ্ডের পর দেশে ফিরে সাংবাদিক বৈঠকে স্মিথ যখন ভেঙে পড়েন, পিঠে নেমে এসেছিল বাবার আশ্বাসের হাত। নির্বাসিত হওয়ার পর বাবাই ক্রিকেট কিট ছুড়ে ফেলেছিলেন গ্যারেজে।

ধীরে ধীরে স্কুলদলে সুযোগ, সেখান থেকে বয়সভিত্তিক দলে। স্মিথের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটতে শুরু করেছিল খুব কম বয়স থেকেই। তবে অবাক করা ব্যাপার এটাই, যে স্মিথ এখন বিশ্বের অন্যতম ত্রাস সৃষ্টিকারী ব্যাটসম্যান, তাঁর কেরিয়ার শুরু হয়েছিল বোলার হিসেবে। অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে ব্যাটের চেয়ে বলের জাদুতেই প্রশংসিত হয়েছিলেন বেশি। এমনকী, জীবনের প্রথম অ্যাশেজ সিরিজে তাঁকে নেওয়া হয়েছিল অফ–ব্রেক বোলিং করতে পারবেন বলে। তাঁর বোলিংয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন স্বয়ং শেন ওয়ার্ন।

ট্রেন্ট উডহিলের সংস্পর্শে আসার পর স্মিথ পুরোপুরি ব্যাটিংয়ে মন দিতে শুরু করেন। স্মিথের ‘‌আন অর্থোডক্স’‌ ব্যাটিংয়ের শুরু উডহিলের হাত ধরেই। সাদারল্যান্ড ক্রিকেট ক্লাবের কোচ উডহিল ১৫ বছর বয়সী স্মিথকে একঝলক দেখেই বুঝেছিলেন, তাঁর হাতে কী জিনিস এসেছে। বলা হয়, স্মিথ নাকি ব্যাকরণ মেনে ব্যাটিং করেন না। তাঁর ব্যাটিংয়ের মধ্যে নাকি কোনও সৌন্দর্য নেই!‌ সাফল্য কিন্তু সেকথা বলে না। সাধে কি কিছুদিন আগে উডহিল বলেছেন, ‘‌ভারতীয় হলে হয়তো স্মিথের টেকনিক নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠত না।’‌ আর দলের ডাক্তার পিটার ব্রুকনার বলেছিলেন, ‘‌৫০ না ১০০, কত রান করল, তা নিয়ে স্মিথ একদম মাথা ঘামায় না। ও শুধু সারাদিন ব্যাট করে যেতে চায়।’‌

পশুপাখি প্রচণ্ড ভালবাসেন স্মিথ। তাঁর সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন ছবি রয়েছে জীবজন্তুর সঙ্গে। কিন্তু খেলার মাঠে তিনি খেলা ছাড়া আর কিছু ভাবেন না। বিরতিতে সতীর্থরা যখন রিল্যাক্স করেন, স্মিথ পড়ে থাকেন খেলার খুঁটিনাটি নিয়ে। নিজের ব্যাটিংয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণের পাশাপাশি সতীর্থদের ভুলত্রুটিও শুধরে দেন। অস্ট্রেলিয়া কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গার দিয়েছেন আরও আশ্চর্যজনক তথ্য, স্মিথ নাকি শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়েও শ্যাডো–ব্যাটিং করেন!‌

কিন্তু সফল ক্রিকেটার স্মিথের জীবনে দমকা ঝড়ের মতোই ফিরে ফিরে আসে বিতর্ক। ২০১৬ সালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে রিভিউ বিপক্ষে যাওয়ায় মাঠে দাঁড়িয়েই আম্পায়ারকে কটূ কথা বলেছিলেন। ৩০ শতাংশ ম্যাচ ফি কাটা যাওয়ায় বলেছিলেন, ‘‌এই শাস্তি মাথায় রাখব। নেতা হিসেবে আরও পরিণত হতে হবে আমাকে। নিজের ভুলগুলো থেকে শিখতে চাই।’

বছর ঘুরতে না ঘুরতে দেখা গেল কিছুই বদলায়নি। ভারতের বিরুদ্ধে বেঙ্গালুরু টেস্টে ডিআরএস নেওয়ার সময় ড্রেসিংরুমের দিকে তাকিয়েছিলেন সাহায্য চাইতে। আম্পায়ারদ্বয় এবং বিরাট কোহলি তীব্র প্রতিবাদ করায় ব্যাপারটা সেখানে থামে। কিন্তু সাংবাদিক বৈঠকে এসে অপরাধ স্বীকার করে নেন। সেদিনই ক্রিকেট বিশ্ব পেয়েছিল নতুন এক শব্দ— ‘‌ব্রেন ফেড’‌।

কিন্তু ২০১৮–র মার্চে কেপ টাউনে যা ঘটেছিল, তা শুধু স্মিথ কেন, গোটা অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের কাছেই চরম কলঙ্কজনক অধ্যায়। অস্ট্রেলীয়দের ‘‌মারি অরি পারি যে কৌশলে’‌ মানসিকতা যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকলেন স্মিথ। সেখানেও অপরাধ স্বীকার না করে বল–বিকৃতির দায় দলের ‘‌লিডারশিপ গ্রুপ’‌–এর দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটু এগোতেই গোটা ঘটনা বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।

কেরিয়ারের তুঙ্গে এক বছরের নির্বাসন যে–কোনও ক্রিকেটারের জীবন চুরমার করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। স্মিথ তা হতে দেননি। শাস্তি মেনে নিয়ে নিজেকে আমূল বদলে ফেলেছেন। নীরবে শান দিয়ে গিয়েছেন নিজের অস্ত্রে। বিশ্বকাপ নয়, তাঁর পাখির চোখ ছিল অ্যাশেজই। আত্মাভিমানী ইংরেজদের বিরুদ্ধে পুরনো হিসেব বুঝে নেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। সেই লক্ষ্যে তিনি চূড়ান্ত সফল। গোটা বিশ্বের কুর্নিশ আদায় করে ছেড়েছেন। কিন্তু কলঙ্কিত অধ্যায় এখনও জীবন থেকে মুছে যায়নি।
আরও কতটা পথ পেরোতে হবে তাঁকে?‌‌‌‌‌ ‘মানুষ’ হতে?

আজকের বাজার/লুৎফর রহমান